অটিজম প্রকল্প: কাজ শুরু হওয়ার আগেই খরচ ৫৫ কোটি টাকা

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি

ঢাকা: অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রীকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এ বিষয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন নানা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। তাঁরই অনুপ্রেরণায় সরকার অটিজম শিশুদের জন্য একটি একাডেমি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিস-এবিলিটিজ (এনএএএনডি)’ নামে ২০১৪ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু ছয় বছরেও প্রকল্পের মূল কাজ শুরুই হয়নি। অনিয়ম আর অদক্ষতায় ডুবতে বসেছে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এই প্রকল্প।

জানা যায়, ৪২২ কোটি টাকার এই প্রকল্পের শুরু ২০১৪ সালে, যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। এরপর তা প্রথম পর্যায়ে সংশোধিত হয়ে মেয়াদ বাড়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও কাজের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৩ সাল পর্যন্ত। তবে সম্প্রতি পূর্বাচলে ৩.৩৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ছয় বছরে প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, জমি অধিগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ হয়ে গেছে ১৩ শতাংশ অর্থ অর্থাৎ ৫৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘অটিজম প্রকল্পের আগের পরিচালকের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল। তাঁকে সরিয়ে নতুন পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে একাডেমির জন্য জায়গা না পাওয়াই মূল সংকট ছিল। এ ছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়ে এখনো একটি মামলা চলছে। এখন পূর্বাচলে জায়গা পাওয়া গেছে। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর দ্রুত কাজ শুরু হবে। তবে একাডেমি নির্মাণের আগ পর্যন্ত ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুরু থেকেই প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক সালমা বেগম। পূর্ব অভিজ্ঞতাবিহীন এই পিডি কোনো কাজই এগোতে পারেননি। অথচ ঠিকই নিজে বিলাসবহুল গাড়ি, মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতাসহ নানা সুবিধা ভোগ করেছেন। প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করতে না পারলেও অর্থ খরচ করা থেকে তিনি বিরত থাকেননি।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত খরচ হওয়া প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মধ্যে জমি অধিগ্রহণে গেছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের সাত কর্মকর্তার বেতন বাবদ গত ছয় বছরে ব্যয় হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। বাকি প্রায় ১৬ কোটি টাকা প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ভাতা বাবদ এরই মধ্যে খরচ হয়েছে।

জানা যায়, অটিজম ও এনডিডি বিষয়ক মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণে আটটি ব্যাচে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৪০০ জনকে, সেখানে খরচ হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ টাকা। অটিজম ও এনডিডি বিষয়ক অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে ২১৪টি ব্যাচে ৯ হাজার ২০ জনকে প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়েছে আট কোটি ৮৬ লাখ টাকা। উপজেলা পর্যায়ে দিনব্যাপী ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপে ৩৯২টি উপজেলায় ৩৯ হাজার ২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে ব্যয় হয়েছে চার কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর সচেতনতামূলক কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৬ লাখ টাকা।

তবে মাউশি অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রশিক্ষণের প্রায় পুরো টাকাই জলে গেছে। কারণ একাডেমি স্থাপিত হলে প্রশিক্ষণগ্রহণকারীদের কাজ শুরু হবে। পাঁচ-ছয় বছর আগে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁদের কিছু মনে থাকার কথা নয়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া বিল-ভাউচারের নামে লুটপাট করা হয়েছে বেশির ভাগ টাকাই।

গত জুন মাসে প্রকাশিত মাউশি অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের মনিটরিং রিপোর্টে প্রকল্পটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে অবশিষ্ট কাজের বাস্তবায়ন এখনো দৃশ্যমান হয়নি।

তবে গত ফেব্রুয়ারিতে সালমা বেগমকে সরিয়ে নতুন পিডি হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ দিদারুল আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পরও কাজে গতি আসেনি। আবার প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য সালমা বেগমের কাছে কোনো কৈফিয়তও চায়নি মাউশি অধিদপ্তর।

জানা যায়, অটিজম স্পেকট্রাম ডিস-অর্ডার (এএসডি) এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিস-এবিলিটিজ শিশুদের শিক্ষার মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতেই নির্মাণ করা হবে জাতীয় অটিস্টিক একাডেমি। তাদের বৃত্তিমূলক ও অন্যান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষম করে গড়ে তোলা হবে। শিক্ষক, অভিভাবক ও অন্য অংশীজনদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতেও কাজ করবে একাডেমি।

সূত্র মতে, পূর্বাচলে প্রকল্পের নির্ধারিত জায়গায় একাডেমিতে প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভবন, হেলথ কেয়ার সেন্টার, খেলার মাঠ রাখার কথা। এসব কাজের তদারকি ও নকশা করার জন্য এ পর্যন্ত তিনবার দরপত্র আহ্বান করেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রকল্পের জন্য প্রথম ২০১৭ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে দুটি প্রতিষ্ঠান কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কোনো প্রস্তাব গ্রহণ না করে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে। এবার শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস দেয় ছয় কোটি ৫০ লাখ ৯১ হাজার ৫৮ টাকার প্রস্তাব। আর ভার্নাকুলার কনসালট্যানস প্রস্তাব দেয় ১৩ কোটি ১১ লাখ ৯৮ হাজার টাকার। কিন্তু কমিটি ভার্নাকুলারকেই চূড়ান্ত করার চেষ্টা করে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ওই দরপত্রও বাতিল করা হয়। সর্বশেষ গত বছর তৃতীয় দফায় দরপত্র ডাকা হয়। এতে অংশ নেয় ছয়টি প্রতিষ্ঠান। ‘সৃজনী উপদেষ্টা লি.’ সর্বনিম্ন দর দেয় এক কোটি ছয় লাখ টাকা। তারা কারিগরি প্রস্তাবে ৭৮.১২ পেয়ে চতুর্থ স্থান পেলেও আর্থিক প্রস্তাবে প্রথম স্থানে থাকায় সর্বোচ্চ নম্বর পায়। কারিগরি প্রস্তাবে এবার সর্বোচ্চ নম্বর ৯৬ পায় ‘শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড ইন অ্যাসোসিয়েশন উইথ ট্রায়াঙ্গল কনসালট্যান্ট’। তবে তারা পাঁচ কোটি ৮২ লাখ টাকার আর্থিক প্রস্তাব দেওয়ায় গড় নম্বরে পিছিয়ে যায়। কিন্তু কারিগরি প্রস্তাব বিবেচনা না করে সৃজনী লি.কে কাজ দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন বর্তমান পিডি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অটিস্টিক একাডেমি নির্মাণকাজে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৩ জন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। তাঁরা ছয় থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কাজ করবেন। তাঁদের মধ্যে স্থপতি, পুর প্রকৌশলী, অটিজম বিষয়ের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পরামর্শক আছেন। মাত্র এক কোটি টাকায় ‘সৃজনী উপদেষ্টা লি.’ তিন বছর মেয়াদে পরামর্শ ও নকশা কিভাবে করবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া এত কম টাকায় কোনোভাবেই কাজ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে ‘শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড ইন অ্যাসোসিয়েশন উইথ ট্রায়াঙ্গল কনসালট্যান্ট’। অভিযোগে বলা হয়, মাত্র এক কোটি ছয় লাখ টাকা দর দিয়ে ভালো মানের কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। যে প্রতিষ্ঠানটি এই দর দিয়েছে তারা কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবে যথাযথভাবে কার্যপরিধি প্রতিপালন করেনি।

এ ব্যাপারে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আ মো নু সোবহান বলেন, ‘মাত্র এক কোটি টাকায় অটিজম প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করাটা অসম্ভব। এক হতে পারে যখন মানুষের মনোযোগ এই প্রকল্প থেকে সরে যাবে তখন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যয় বাড়াবে। আর যে সেবা দেওয়া দরকার তা দেবে না। অথবা তারা কোনো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজটি চালিয়ে নেবে।’

তবে বিষয়টি নিয়ে ভার্নাকুলার কনসালট্যান্ট লি. একটি রিট মামলা করলে আদালত দ্বিধাবিভক্ত রায় দিয়েছেন। মামলাটি এখন প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে। এ জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃজনী উপদেষ্টা লি.-র সঙ্গে এখনই কোনো চুক্তিতে না যেতে সম্প্রতি পিডিকে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এসব বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে মামলা চলমান থাকায় আপাতত নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ এত কম টাকায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন কোনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের যদি নিজের অভিজ্ঞতা থাকে, সে যদি রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে সে কম টাকায়ও কাজ করতে পারে।’

মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘অটিজম প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। আশা করছি শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে। আমরাও দ্রুত মূল কাজ শুরু করতে পারব।’

সৌজন্যে কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *