অনিক ও সকালের পা ধরেও রক্ষা পাননি আবরার

Slider শিক্ষা

ঢাকা:পাশবিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হামলাকারী অনিক সরকার ও ইফতি মোশাররফ সকালের পা জড়িয়ে ধরে এক পর্যায়ে। এতেও হামলাকারীদের মন গলেনি। তারা নির্দয়ভাবে আবরারকে পেটাতে থাকে।

সোমবার রবিন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। ওই জবানবন্দি ও তদন্ত-সংশ্নিষ্ট অন্যান্য সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। রবিন স্বীকার করেছে, আবরারকে ধরে আনার পর সে তাকে চড়-থাপ্পড় মেরেছিল।

হামলার তিন-চার দিন আগে বুয়েটের ক্যান্টিনে বসে শলাপরামর্শ করা হয়। সেখানে আলোচনায় আসে, কারা বুয়েটে শিবির করছে তা খুঁজে বের করতে হবে। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিল বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসান রবিন।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ৪ অক্টোবর রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে কিছু নির্দেশনা দেয়। এতে বলা হয়, ‘আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে। ওকে হল থেকে বের করে দিবি দ্রুত। এর আগেও বলেছিলাম। তোদের তো দেখি কোনো বিগার নাই। শিবির চেক দিতে বলেছিলাম।’ এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপের সাড়া দেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা, মনিরুজ্জামান মনিরসহ কয়েকজন।

নির্যাতনের সময়ে এক পর্যায়ে অনিক সরকার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকে। এতে আবরার শিবির সম্পর্কে এলোমেলো কিছু তথ্য দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আবরারকে চড় মারে এবং স্টাম্প দিয়ে পেটায় সকাল। এ সময় মেহেদি মোবাইল ফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে কথা বলে। হামলার এক পর্যায়ে আবরার বমি করে। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তার কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেদি আবরারকে বলে, ‘ও ভান ধরেছে’। এক পর্যায়ে মেহেদি হামলাকারী অন্যদের বলে, ‘ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সবাই নিচে নেমে আয়।’

শিবির সন্দেহে পেটানো হয় আবরারকে: হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বন্ধু ও সহপাঠীরা বলে আসছিল, শিবির সন্দেহে আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। তবে তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাৎক্ষণিকভাবে হত্যার কারণ নিশ্চিত হতে পারেনি। অবশ্য হত্যায় জড়িত ১৯ আসামিকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও পাঁচ আসামির জবানবন্দিতে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে শিবির সন্দেহেই আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

সোমবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) ও ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আদালতে জবানবন্দি ও আসামিদের কথায় উঠে এসেছে যে তারা শিবির সন্দেহে আবরারকে ডেকে নিয়ে মারপিট করছিল। একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়। তবে হত্যার উদ্দেশ্যেই মারপিট করেছিল, নাকি অন্য কিছু ছিল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

মনিরুল বলেন, বাকিদের জবানবন্দির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্নেষণ ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, তারা আবরারকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করেছিল কি-না। কারও কারও জবানবন্দিতে এসেছে কয়েক ঘণ্টা ধরে মারধর করা হয়েছে।

ওই ঘটনার সময়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা দিয়ে ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ খবর পেয়ে রাত ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের কেউ কেউ বলেছে, পুলিশ যাওয়ার আগেই আবরার মারা গেছে।

অমিত সাহাকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিস্কার: আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পেয়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহাকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। অমিতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ‘অধিকতর তদন্তে’ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বহিস্কার করা হয় বলে সোমবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বুয়েটের সাম্প্রতিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। ওই কমিটির অধিকতর তদন্তে উঠে এসেছে, অমিত সাহা ওই ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথোপকথনের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অধিকতর তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিস্কার করা হলো।

অমিত সাহা বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের যে কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ওই কক্ষটিতে থাকত সে। আবরার হত্যা মামলায় আসামি করা না হলেও সম্পৃক্ততা পেয়ে গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন সোমবার সমকালকে জানান, আবরারকে পেটানো বা হত্যাকাণ্ডের সময়ে অমিত সাহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে তার সম্পৃক্ততা মিলেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঘটনায় তার ভূমিকার বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আবরার হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৯ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৫ জন ও এজাহারের বাইরে চার আসামি রয়েছে। তাদের মধ্যে সকাল, জিয়ন, অনিক, মুজাহিদ ও রবিন নামে ৫ জন স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া রিমান্ড শেষে রাসেল, ফাহাদ, জেমি, তানভীর ও মুন্না নামে পাঁচ আসামিও কারাগারে রয়েছে। মিজান নামে অপর একজন আসামি অসুস্থ থাকায় আপাতত তাকে রিমান্ডে নেওয়া না হলেও আরও ৮জন রিমান্ডে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *