তিতাসের মৃত্যুর অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে

Slider জাতীয় টপ নিউজ


মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এক নম্বর ফেরিঘাটে একজন ভিআইপির (যুগ্ম সচিব) অপেক্ষায় প্রায় দুই ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখার কারণে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। ফেরি দেরিতে ছাড়ার জন্য ওইদিন দায়িত্বরত ফেরি ঘাটের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটি আলোচিত যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। তবে ওই যুগ্মসচিবের জন্য ২ ঘণ্টা ফেরি দাঁড় করিয়ে রাখার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করার জন্য আজ বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী ১৩ অক্টোবর হাইকোর্ট নিয়মিত খোলার পর প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। যদিও ২৩ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ রয়েছে হাইকোর্টের। প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এরকম অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স/গাড়ি পারাপারের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে যে তিনজনকে দায়ী করা হয়েছে তারা হলেন-ঘাট ম্যানেজার মো. সালাম হোসেন, প্রান্তিক সহকারী মো. খোকন মিয়া এবং উচ্চমান সহকারী ও গ্রুপ প্রধান ফিরোজ আলম। তাদের বিরুদ্ধে কর্মে অবহেলা, ঘাট ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও বিআইডব্লিউ পরিপত্র লঙ্ঘন করে বিলম্বে ফেরি ছাড়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তাদের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ঘাটে লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীবাহী অ্যাম্ব্যুলেন্স ফেরি পারের জন্য অপেক্ষা করছে এটা জানা থাকা সত্বেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অ্যাম্ব্যুলেন্স পারাপারে সহায়তা না করে ‘কুমিল্লা ফেরি’ নির্ধারিত সময়ের আনুমানিক ২ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। ফলে অনাকাঙ্খিত ঘটনা সৃষ্টিতে তারা (তিনজন) দায়ভার এড়াতে পারে না। ফেরি ছাড়তে যদি ২ ঘণ্টা দেরি না করতো তাহলে হয়তো তিতাসকে বাঁচানো সম্ভব হতো।

আর যে যুগ্মসচিবের জন্য ফেরি ছাড়তে দেরি করা হয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুগ্মসচিব সরকারি সফরে থাকায় যে রুটে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল, সে রুটে ধর্মঘট চলায় বিকল্প রুট হিসেবে মাদারিপুরের কাঠালবাড়ি ফেরি ঘাটে যান। এজন্য তিনি আগেই মাদারিপুরের জেলা প্রশাসকের সহায়তা চান। জেলা প্রশাসক ঘাটের ম্যানেজারকে বিষয়টি জানান। এরপর ম্যানেজারের সঙ্গে যুগ্মসচিবের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মুমুর্ষ রোগী অপেক্ষা করছে-এই তথ্য ঘাট ম্যানেজার যুগ্মসচিব বা জেলা প্রশাসককে জানাননি। এ কারণে তিনি (যুগ্মসচিব) জানতেন না যে, ঘাটে মুমূর্ষু রোগী অপেক্ষা করছে। তাই তাকে (যুগ্মসচিব) অভিযুক্ত করার মতো যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।

প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ জাতীয় অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে যে ৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে, তা হলো

১. ঘাট থেকে ফেরি ছাড়া ও পৌঁছানোর সময় স্থায়ী লগবুক/রেজিষ্ট্রারে লিখে মাস্টারকে স্বাক্ষর করতে হবে।
২. ফেরি ঘাটে ভিড়িয়ে বা ফেরির র‌্যাম্প উঠিয়ে কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।
৩. নীতিমালা অনুযায়ী ভিআইপি সুবিধা চেয়ে কেউ ফেরি পারাপার হতে চাইলে তাকে অবশ্যই তার সরকারি ভ্রমণ বিবরণী আগে হতে ফেরি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। তবে জরুরি প্রয়োজনে আগে যোগাযোগ সাপেক্ষে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ম শিথিল করা যেতে পারে।
৪. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহি অ্যাম্বুলেন্স/গাড়ি পারাপারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. প্রত্যেক ঘাটে ও ফেরিতে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে গাড়ি ও ফেরি পারাপারের বিষয় সমূহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. ফেরিঘাট ও ফেরিতে কর্মরত সকলের নাম ট্যাগসহ নির্দিষ্ট পোষাক (ইউনিফর্ম) পরিধান করতে হবে। এবং ৭. ফেরিঘাট ও ফেরিতে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল নম্বরসমূহ প্রদর্শন করতে হবে।

গত ২৫ জুলাই রাতে সরকারের এ টু আই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির অপেক্ষায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এক নম্বর ফেরিঘাটে প্রায় ২ ঘণ্টা ‘কুমিল্লা ফেরি’ বসিয়ে রাখা হয়। ফেরিঘাটে আটকে পড়া স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহণকারী অ্যাম্বুলেন্স পার করার জন্য বারবার অনুরোধ জানিয়েও ফেরি ছাড়া যায়নি। ফলে অ্যাম্ব্যুলেন্সেই মৃত্যু হয় তিতাসের। এ ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে তিতাসের পরিবারকে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জহির উদ্দিন লিমনের করা এক রিট আবেদনে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৩১ জুলাই এক আদেশে ঘটনা তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। অতিরিক্ত সচিবের নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি গঠনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিটিকে তিন সপ্তাহের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই নির্দেশের একদিন আগেই ৩০ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় গত ২৮ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ আদালত থেকে আরো সময় নেয়। এ অবস্থায় কমিটি তদন্ত শেষে হাইকোর্টে দাখিল করার জন্য ৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার দুপুরে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে জমা দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *