৩৫০ কোটি টাকা লুটে লাপাত্তা শামিম

Slider জাতীয়

একই জমি একই ফ্ল্যাটের দলিল জামানত রেখে একাধিক ব্যাংক থেকে তুলেছেন ঋণ। ভুয়া কোম্পানি দেখিয়ে ঋণ নিতে জালিয়াতির অভিনব এ ঘটনা ঘটে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকে। একসময়ের ক্ষুদ্র স্টেশনারি সাপ্লাই ব্যবসায়ী এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। বিত্ত-বৈভব গড়েছেন দেশ ও দেশের বাইরে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। কোম্পানি একই, শুধু নাম পাল্টিয়ে একই জমি, ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন লাপাত্তা মুজিবর রহমান শামিম নামে এক ব্যবসায়ী। কখনো ট্রেডিং ব্যবসা, কখনো কারখানার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে আর ফেরতও দিচ্ছেন না। সব ব্যাংকেই এখন খেলাপিতে পরিণত তার ঋণ। ঋণ নিতে তিনি নিজের একাধিক ঠিকানাও ব্যবহার করেছেন। এ ঠিকানায় রয়েছে ঢাকা ও খুলনায় অফিস ও নিজের স্থায়ী ঠিকানা। ব্যাংকগুলোর ঢাকা ও খুলনার শাখা থেকে এসব ঋণ নিয়েছেন সুবিধা অনুযায়ী। নিজের নামের পাশাপাশি বেনামে ঋণ নেওয়ার পর এখন ব্যাংকগুলো তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে, মুজিবর রহমান শামিম সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের রাজধানীর নবাবপুর শাখা থেকে- প্রায় ১৯২ কোটি টাকা।
চারটি কোম্পানির বিপরীতে এ ঋণ নিয়েছেন তিনি। কোম্পানিগুলো হচ্ছে জয় পেট্রোলিয়াম, জয় এন্টারপ্রাইজ, জয় ফিড মিল, জয় জুট প্রসেসিং। প্রথম সারির ওই ব্যাংকটির ঋণগ্রহীতা জয় এন্টারপ্রাইজ জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়ে গেছে নিউ জয় এন্টারপ্রাইজ। এই নিউ জয় এন্টারপ্রাইজের বিপরীতে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা। ট্রাস্ট ব্যাংক খুলনা শাখায় রয়েছে দুটি কোম্পানির নামে ঋণ। সাউথ হ্যাচারি ও এগ্রো এবং জয় শিপিং নামের কোম্পানির বিপরীতে ঋণ নিয়েছেন ২৩ কোটি টাকা। সাবেক ফারমার্স ব্যাংক বর্তমান পদ্মা ব্যাংক খুলনা শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন ২৫ কোটি টাকা। এর বাইরে বেসরকারি আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকেও তিনি নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংকের কাগজপত্রে দেখা গেছে, মুজিবর রহমান শামিম ঋণ নিতে ব্যবহার করেছেন নিজের চারটি ঠিকানা। তিনটি অফিস ঠিকানা একটি রাজধানীর নিকেতন ডি ব্লকের ৪৬ নম্বর বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট বি-১, দ্বিতীয়টি ১৫ বড় মগবাজার পঞ্চম তলা, তৃতীয়টি খান টাওয়ার চতুর্থ তলা এ-৫০ মজিদ সরণি শিববাড়ী মোড় খুলনা এবং নিজের স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার উমাজুরি গ্রাম। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে যেসব বন্ধক দিয়েছেন ঘুরেফিরে তার সবই একই ফ্ল্যাট ও জমি। ট্রেডিং ব্যবসার নামে এই কোম্পানির বিপরীতে জনতা ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকার ঋণের বন্ধক হিসেবে দিয়েছেন রাজধানীর নিকেতনে ১ হাজার ৪৪০ বর্গফুটের নজর অ্যালবাম হোল্ডিং-৩৬, রোড-১ একটি ফ্ল্যাট, মহাখালীতে সাড়ে ৮ ডেসিমেল জমি। এই একই স্থাপনা বন্ধক দিয়ে সিলভার ট্রেডিং কোম্পানির নামে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন সাবেক ফারমার্স ব্যাংক খুলনা শাখা থেকে। আরেক বেসরকারি ব্যাংকের রাজধানীর নবাবপুর শাখা থেকে কয়েকটি কোম্পানির বিপরীতে সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছেন প্রায় ১৯২ কোটি টাকা। ওই ঋণের বিপরীতে বন্ধক হিসেবে রয়েছে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ছোট কুমারখালী গ্রামের জমি, ইস্কাটনের ফ্ল্যাট ও কমার্শিয়াল স্পেস, খুলনার বটিয়াঘাটায় জমি। এ চার স্থানের জমি, ফ্ল্যাট ও কমার্শিয়াল স্পেস বন্ধক হিসেবে ব্যবহার করেছেন অন্য ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রেও। জালিয়াতির নানা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণে সিলভার ট্রেডিং, নবাবপুর শাখার ওই ব্যাংকটির ঋণেও সিলভার ট্রেডিং এবং জনতা ব্যাংকে নিউ জয় এন্টারপ্রাইজ একই ট্রেডিং ব্যবসা। শুধু নাম পাল্টিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ তুলেছেন। এসব ঋণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে একই বন্ধক। এর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৪৪০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, রাজধানীর নিকেতন রোড-১ হোল্ডিং-৩৬ এবং মহাখালীতে গুলশান মৌজার সাড়ে ৮ ডেসিমেল জমি। সিলভার ট্রেডিংয়ে ঋণ নিতে ফারমার্স ব্যাংক ও নবাবপুরের ব্যাংক শাখাটিতে আরও বন্ধক রয়েছে; যা দুই ব্যাংকে একই। এগুলো হলো ১ হাজার ৬৪৯ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট, খিলগাঁও ৭, বি-২ সপ্তম তলা ও দশমিক ২৪ ডেসিমেল জমি। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার রুস্তমপুর মৌজার ৯৪ ডেসিমেল জমি। এ জমিটি বন্ধক হিসেবে রয়েছে জনতা, ফারমার্স ও নবাবপুর শাখার সেই ব্যাংকেও। খুলনার মহেশ্বরপাড়া এসএ ১০ দাগ ৬১০২, ৬১০৩, ৬১০৪ দাগের ২ দশমিক ৮৯ ডেসিমেল জমি নবাবপুরের ব্যাংক শাখাটিতে জয় এন্টারপাইজ ও জনতা ব্যাংকে নিউ জয় এন্টারপ্রাইজের বন্ধক। ব্যাংকগুলোতে মোট দেড় হাজার ডেসিমেল জমি বন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ট্রাস্ট ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইইএফ ফান্ড ও আরও একটি প্রধান সারির ব্যাংক ঋণ নিতে একই জমি বন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ছোট কুমারখালী মৌজার ২৪৫/১, ২৪৫/৭ খতিয়ানের ১ হাজার ৫০ ডেসিমেল জমি রয়েছে। খুলনার বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলা মৌজার পিএস-৫৫ হাল এসএ ২৫১, ২৫২ খতিয়ানের ৫০০ ডেসিমেল জমি নবাবপুর শাখার ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকে সিলভার ট্রেডিংয়ের জন্য বন্ধক দেওয়া। খুলনার দৌলতপুর মৌজার ৬.৬০ ডেসিমেল জমি জনতা ব্যাংক ও আইসিসি ইইএফ ফান্ডের বন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ঋণগ্রহীতার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, টার্ম লোন, এলসি খুলতে এসব জমি বন্ধক হিসেবে রয়েছে। জনতা ব্যাংকের ঋণ নেওয়া হয় ২০১৬ সালে, নবাবপুর শাখার ব্যাংকটি থেকে নিয়েছেন ২০১৭ সালে, ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২০১৪ সালে, ফারমার্স ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২০১৬ সালে। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতা কারখানার যেসব ঠিকানা দিয়েছেন তার অনেকটি পুরোপুরি ভুয়া। জয় পেট্রোলিয়াম, সাউথ হ্যাচারি অ্যান্ড এগ্রো লিমিটেড নামের কোম্পানির ঠিকানা পুুরোপুরি ভুয়া। শুধু কোম্পানির কাগজপত্র ব্যবহার করেই ঋণ তুলেছেন। ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা হাতিয়ে এখন লাপাত্তা এই মুজিবর রহমান শামিম। খেলাপিতে পরিণত হওয়া ঋণ আদায়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা খুঁজে পাচ্ছেন না তাকে। বেনামে ঋণ রয়েছে আরও একাধিক ব্যাংকে। আর বন্ধকের জমি দখল করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো দেখছে আরও একাধিক ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা। এসব জটিলতায় এখন এই ঋণ আদায়ের সব সম্ভাবনা কঠিন হয়ে পড়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঋণের প্রধান শর্ত সম্পত্তি বন্ধক। এ নিয়ে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রে বন্ধক দেখানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া বন্ধক থাকা জমিতে ব্যাংকের সাইনবোর্ড থাকা জরুরি। অনেকে তা মানছেন না। এজন্য অনেকের যোগসাজশে এ রকম অনিয়ম ঘটে। যদি কেউ এমনটি করেন বুঝতে হবে এতে শুধু গ্রাহক নয়, ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত। খেলাপি ঋণ বাড়ার একটি অন্যতম কারণ সঠিক বন্ধক আছে কিনা তার ওপর নির্ভর করে। ঋণের বিপরীতে বন্ধক দেখার দায়িত্ব ব্যাংক কর্মকর্তাদের। আরেকটি ব্যাংকে বন্ধক রাখার পর আবার কেউ একই জমি বা সম্পদ দেখালে বুঝতে হবে সেটা সবার যোগসাজশে হয়েছে। এদের সবাইকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে। ’ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ঋণ জালিয়াতি অনিয়ম রোধে বন্ধক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরীক্ষা করা উচিত। একই সম্পদ যখন একাধিক ব্যাংক ঋণে বন্ধক হিসেবে দেখানো হয় সেটা বড় ধরনের দুর্নীতি। ঋণ নেওয়ার সময় জমির দলিল জমা রাখতে হয় ব্যাংকে। আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় সেই দলিল দিতে হলে অবশ্যই ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুু ব্যাংকিং বিষয় নয়, আমাদের সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সব ধরনের ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *