নরসিংদী: নরসিংদীর মাধবদীতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর নারীসহ দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি নিহতরা নব্য জেএমবি’র সদস্য। উপজেলার শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকায় এবং মাধবদী ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকায় পৃথক দু’টি আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশ। শেখেরচরের জঙ্গি আস্তানায় গতকাল অভিযান শেষ হলেও গাংপাড়ের আস্তানায় আজ অভিযান চলবে।
‘অপারেশন গর্ডিয়ান নট’- নামে এ অভিযানের পর নারীসহ দুই জঙ্গির লাশ উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গিরা সেখানে চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
অভিযান শেষে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, অভিযানে নিহতদের মধ্যে একজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা নব্য জেএমবি’র সদস্য। প্রাথমিকভাবে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গত ৩রা অক্টোবর এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল তারা। ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার জঙ্গিদের সঙ্গে এখানকার জঙ্গিদের যোগসাজশ রয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, নিহতরা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, না-কি নিজেরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা গেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, অপর জঙ্গি আস্তানা গাংপাড় এলাকায়ও দিনের আলোতে অভিযান চালানো হবে। তাদেরকেও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হবে। আত্মসমর্পণ না করলে আমরা অ্যাকশনে যাবো।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, দুর্গাপূজা এবং সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জঙ্গিরা বড় ধরনের নাশকতার জন্য সংগঠিত হচ্ছে। তারা কোথায় হামলা চালাতে পারে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে ওই দুই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। মাধবদী গদাইরচর গাংপাড় এলাকায় কখন অভিযান চালানো হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছি। রাতভর চেষ্টা করবো, যাতে তারা আত্মসমর্পণ করে। কারণ, আমরা কোনো হতাহতের ঘটনা দেখতে চাই না। যদি তারা আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে দিনের আলোতে সেখানে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা আছে।
এদিকে জঙ্গি আস্তানার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। সকাল থেকেই জঙ্গি আস্তানার আশাপাশের দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
সোমবার রাত ১০ টার পর থেকেই বাড়ি দুটি ঘিরে রাখে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের সদস্যরা। ভোর ৬ টার দিকে আস্তানা দু’টির আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। সরিয়ে নেয়া হয় এলাকার বাসিন্দাদের। শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেটের পাশের বাড়িতে সকাল ১০টার পর অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই বাড়ির মালিক বিল্লাল মিয়া। তিনি ডাইং ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। ইভা টেক্সটাইল মিলের মালিক তিনি। পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে পায় পুলিশ।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিক ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। সকাল ৯টা ৫৩ মিনিটে শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মাকের্টের পাশে অবস্থিত ঘটনাস্থলে আসেন সিটিটি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। রাতেই সেখানে আসেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। জেলা পুলিশ, এন্টি টোরোজিম ইউনিট, সিটিটি’র বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াট এবং সিআইডি’র ক্রাইম সিন ইউনিটসহ আইপ্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরা একে একে ঘটনাস্থলে আসেন। অভিযান শুরুর পর দিনভর থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। জঙ্গিরা বাসার ভেতর থেকে এবং পুলিশ বাইরে থেকে জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বেলা সাড়ে ১২টার পর আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের জানান, আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অপারেশন শেষ করতে পারবো। তিনি বলেন, অপারেশনের প্রটোকল অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থা নেয়ার দরকার সেসব ব্যবস্থা নিয়েই অপারেশন পরিচালনা করছি। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সে সুযোগ নেয়নি। প্রটোকল অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
অপারেশনের নাম ‘গর্ডিয়ান নট’ দেয়ার কারণ হিসেবে আইজিপি বলেন, নট মানে হচ্ছে গেরো। এটা এমন জটিল গেরো যা খুলতে কষ্ট হয়। অপারেশনটা খুব জটিল। এখানে পুলিশের চেয়ে জঙ্গিরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। সুতরাং আমাদের জন্য অপারেশনটা একটু কষ্টকর।
অভিযান শুরুর আগ মুহূর্তে সিটিটি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা আত্মসমর্পণ করেনি। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে অভিযান শুরু হবে। ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে অভিযান চলবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কাউন্টার টেরোরিজমের পাশাপাশি পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল অভিযানে যোগ দিয়েছে। এলাকার লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, জঙ্গি আস্তানায় অনেক বিস্ফোরক দ্রব্য আছে। সেখানে কতজন জঙ্গি আছে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে, মঙ্গলবার সকাল থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন শেখেরটেকের বাড়িতে চারজন জঙ্গি অবস্থান করছে। আর মাধবদী পৌরসভার গাঙপাড় এলাকার আফজাল হাজীর ‘নিলুফা ভিলা’ নামের ৭ তলা একটি বাড়িতে ৩ জঙ্গিকে সোমবার রাত থেকে ঘিরে রাখে সিটিটি সদস্যরা। ওই ভবনের তৃতীয় তলায় ‘মিফতাহুল জান্নাহ্ মহিলা মাদ্রাসা’ নামের একটি মাদ্রাসা আছে। ভবনটির ৭ তলায় জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করে পুলিশ। সকালে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিলুফা ভিলায় তিনজন জঙ্গি অবস্থান করছে। এদের মধ্যে ২ জন নারী ও একজন পুরুষ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, ‘নিলুফা ভিলা’র ওই ফ্ল্যাটটি গত ৬ মাস আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার বাসিন্দা হাফিজ ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি ভাড়া নেয়। সোমবার রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসার ভেতর থেকে লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়।
স্থানীয়দের বক্তব্য: দুপুর ১২টার দিকে শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকার বাসিন্দা বাদল মিয়া ওরফে বাদল বাবুর্চি জানান, এখানে যে এত বড় জঙ্গি আস্তানা থাকতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। সোমবার রাত ১২ টার দিকে বাথরুম করতে বাইরে বের হলে দেখি পুলিশ। পুলিশ আমার পরিচয় জানতে চাইলে আমি এখানকার বাসিন্দা বলে পরিচয় দেই। একপর্যায়ে বাসায় চলে যাই। এরপর আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৮টার দিকে নাস্তা করতে বাইরে বের হই। পুলিশের ব্যারিকেটের এখন বাসায় প্রবেশ করতে পারছি না। তিনি জানান, সকালে জঙ্গি আস্তানার পাশের বাড়ি থেকে নাজমুল (১৭) নামের একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জানা যায়, নাজমুলের মাধ্যমেই জঙ্গিরা বাসাটি ভাড়া নেয়। নাজমুল শেখেরচর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মুদি দোকানদার। বাদল বাবুর্চি জানান, নাজমুলের এক বোনের দেবর ওই জঙ্গিদের ব্যবসায়ী পরিচয়ে নাজমুলের কাছে নিয়ে আসেন। পরে নাজমুলের মাধ্যমে বিল্লাল মিয়ার ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জঙ্গিরা। এই এলাকার সোহেল মিয়া জানান, এলাকাটিতে শিল্প কারখান ও ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এখানে শ্রমজীবী মানুষ বেশি। সোমবার রাতে পুলিশ যখন বাড়িটি ঘেরাও করে তখন আমরা জানতে পারি যে, এখানে জঙ্গি আস্তানা আছে। এর আগে কল্পনাও করতে পারিনি যে, এখানে জঙ্গি থাকতে পারে।
ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার নিলুফা ভিলার পাশের বাড়ির বাসিন্দা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জানান, আমার বাড়ির ঠিক ১০০ গজ দূরে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এখানে জঙ্গি থাকার বিষয়টি আগে কখনও ভাবতেও পারিনি। কারণ, আমাদের এলাকাটি শান্তিপূর্ণ এলাকা। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য বা জঙ্গি-নাশকতা আমরা কল্পনাও করি না। ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন নতুন লোকজন আসেন। নতুন কেউ এলে আমরা মনে করি চাকরি বা ব্যবসা করতে এসেছেন। তাই তাদের ওপর কোনো নজরদারি করি না।