একটি দুর্ঘটনা সুন্দরবনের কান্না

বাধ ভাঙ্গা মত সম্পাদকীয়

tel-1418447454‘জীববৈচিত্র্য’ শব্দটি এখন আর আমার মনে ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি করে না। এর বদলে সেখানে উদ্বেগ এসে ভর করে। সব সময়ই মনে হয়, এই যে সুজলা-সুফলা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অপার সম্ভাবনাময় এই দেশ; আমাদেরই বিচিত্র স্বভাবের কারণে সমস্ত সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটবে না তো? আমার এই আশঙ্কা সম্প্রতি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।

জেনে বা না জেনে, সজ্ঞানে, প্রয়োজনে অথবা অকারণে মানুষ প্রকৃতি নষ্ট করছে। হাতের নাগালে পেলেই ছোঁ মেরে গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলা বাঙালি এখনো নির্দোষ কাজ বলেই মনে করে! তাই হরতাল সফল করতে হাজার হাজার গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখা কিংবা জীবনের উদ্দেশ্য সফল করতে আস্ত একটা পাহাড় কাটার কথা না-ই বা বললাম। জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছি প্রকৃতিবিদ, পরিবেশবাদীদের ডাকে সাড়া না মিললেও প্রতিদিন প্রকৃতির ডাকে রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানে-সেখানে বাঙালির সাড়া দিতে আপত্তি নেই। আমরা এখনো বনে যাই মাইক বাজিয়ে। তারপর উচ্চশব্দে ‘লুঙ্গি ড্যান্স, লুঙ্গি ড্যান্স’ শুনতে শুনতে গাছের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘আহারে! আগের মতো পাখি আর দেখা যায় না।’ কিন্তু কেন দেখা যায় না- এই প্রশ্নটা নিজেকে আর করি না। করার সময়ই বা কোথায়? আমাদের অন্যতম সমস্যা অসহিঞ্চুতা। মনে রাখতে হবে, আমরা এখনো লাইন ধরে বাসে উঠতে পারি না।

তারপরও আশার কথা, আমরা এখনো বনে যাই। সমুদ্র, পাহাড়ে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের আগের তুলনায় বেড়েছে। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবেশ- বিষয়টা এখন আর এতটা জলবৎ তরলং নয়। ‘পরিবেশ’ শব্দটির সঙ্গে ‘বিপর্যয়’ নামে একটি শব্দ এখন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। আমরা বিষয়টা একটু একটু করে বুঝতে শিখছি। নইলে বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন জেনেও আমরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি কীভাবে? কারণ ওই পরিবেশের প্রতি সচেতনতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা। এ কথা এখন আমরা জানি যে, পরিবেশ বাঁচলে দেশটা বাঁচবে। কিন্তু যাদের এই জানাটা আরো জরুরি, তারা কি সেটা অনুভব করেন?

প্রশ্নটা পুনরায় এসেছে সম্প্রতি সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর।  গত মঙ্গলবার ভোরে ঘটনাটি ঘটেছে। ট্যাংকারটিতে সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি ফার্নেস তেল ছিল। ইতিমধ্যে ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেই তেল ছড়িয়ে পড়েছে। ভাবা যায়! যারা বাস্তুসংস্থানের বিষয়টি জানেন তারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন এর ভয়াবহতা। সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। ফলে নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতরে ওই এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। তারপরও সেই পথে নৌযান কীভাবে চলাচল করে- এ এক রহস্যজনক ব্যাপার বটে! যেখানে গত ১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে নৌপথটি বন্ধের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাহলে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে সেই নির্দেশও অমান্য করা হয়েছে। প্রায়ই শোনা যায়, এ দেশে নেতা বেশি, কর্মী কম। কথাটি তাহলে মিথ্যা নয়?

আরেকটি সত্য এ ঘটনায় সামনে এসেছে, আর তা হলো কর্তৃপক্ষের যেকোনো কাজে দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রান্তিকজনের স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের কাজে এগিয়ে আসা। খবরে প্রকাশ, নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল ফোমের সাহায্যে তুলে নেওয়া শুরু হয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা কাজটি শুরু করেছেন। কারণ তেল ছড়িয়ে পড়া রোধে রাবার বুম, স্কিমার, সরবেন্ট ম্যাটারিয়ালসহ যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, তা কর্তৃপক্ষের নেই। সুতরাং যে ফোমের গদিতে আয়েশ করে বসে বড় বড় কর্তারা কথার তুবড়ি ছোটান, সেই গদি বাঁচাতে এখন ওই ফোমই তাদের শেষ ভরসা। এবং এভাবেই হয়তো অতীতের মতো তারা পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু গ্রামের সেই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো যারা ত্রিশ টাকা দরে তেল বিক্রি করা যাবে ভেবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সত্ত্বেও খালি হাতে ড্রাম, ঘটি-বাটি, বালতি নিয়ে তেল অপসারণের কাজ করছেন, তাদের কী হবে? তারাও কী এই মুহূর্তে পরিবেশ বিপর্যয়ে আক্রান্ত নন? আমার ধারণা, প্রথম ধাক্কাটা তাদের ওপর দিয়েই যাবে। কেননা, শ্যালা নদীর পানি দিয়েই স্থানীয়রা পানির চাহিদা মেটায়। সুতরাং দ্রুত এবং ভালোভাবে এই পানি পরিষ্কার না করলে তাদের চরম পানিকষ্টে ভুগতে হবে এবং পানিবাহিত রোগ এলাকায় মহামারি আকার ধারণ করবে।

সুন্দরবনের নদীতীরবর্তী এলাকার মানুষগুলোর অন্যতম পেশা হচ্ছে মাছ ও রেণু পোনা ধরা এবং গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করা। বনে তেল ছড়িয়ে পড়ায় এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে, এটা ধরে নেওয়া যায়। সুতরাং এই ঘটনার প্রথম প্রত্যক্ষ প্রভাব তাদের ওপর ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। এরপর আমি বলব প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। সুন্দরবনের মংলা থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকায় আট প্রজাতির ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে কম স্থানে বেশি প্রজাতির ডলফিনের বিচরণ এলাকা। এ ছাড়াও রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিশ্বের বিপন্ন প্রজাতির প্রায় ১৫ ধরনের প্রাণী বনের এই এলাকায় বিচরণ করে। ফলে এ ঘটনায় তাদের জীবনও যে বিপন্ন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাস্তুসংস্থানের নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশ এবং সেই পরিবেশের প্রতিটি প্রাণী একে অপরের পরিপূরক। ফলে একটির জীবনের সঙ্গে অন্যটির জীবন জড়িয়ে আছে। বাস্তুসংস্থানগত দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এই তেল ভাসতে ভাসতে একসময় নদী, নদীর পাড়, পাড় থেকে বনে, এমনকি বনের প্রাণীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। যেমন তেল বনের শ্বাসমূলে লেগে আটকে থাকবে। স্বাভাবিকভাবে তখন গাছগুলো নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। ফলে সেগুলো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। গাছের পাতা খেয়ে কিডনি অকার্যকর হয়ে মারা যাবে বনের তৃণভোজী প্রাণী। আবার ছোট ছোট সেই তৃণভোজী প্রাণী খেয়ে মারা যাবে মাংসাশী প্রাণী। এভাবে আক্রান্ত এলাকার ডলফিন, উদবিড়াল, গুইসাপ এবং সব ধরনের ক্ষুদ্র জলজ প্রাণীগুলো তো বটেই, ডাঙায় থাকা প্রাণীগুলোও আস্তে আস্তে মারা যাবে। কান্নার রোল উঠবে বনজুড়ে। আফসোস শুধু এই, সেই অদৃশ্য কান্না কর্তৃপক্ষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না।

পরিবেশবাদীদের অনেক প্রতিবাদই সরকারের কানে পৌঁছায় না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনে সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর দূষণের কথা এলে তারা বলেছিল, এটা বড় কোনো সমস্যা না। এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করলে কোনো ঝুঁকি থাকবে না। কথাটি কতটা অন্তঃসারশূন্য, এর প্রমাণ এই দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত আমরা কোনো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে দেখিনি। শুধু তাই নয়, ডুবে যাওয়া জাহাজটি টেনে তোলার কাজেও দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত সেই ‘ময়নার বাপ’ই আমাদের ভরসা। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এই দুর্ঘটনাই যদি আমরা সামাল দিতে না পারি তাহলে পারমাণবিক দুর্ঘটনা যদি ঘটে, তখন আমরা কীভাবে তা সামাল দেব? ভাবিয়া কাজ করাটাই কি প্রকৃত বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়? আর একটা কথা কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতি বরাবরই প্রতিশোধপরায়ণ। তাকে অবহেলা করলে একসময় সে প্রতিশোধ নেবেই। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় ভয়ংকর, বড় নির্মম। তখন ওই ঘটি-বাটি দিয়ে ময়নার বাপ শত চেষ্টাতেও কিছু করতে পারবে না জীবন দেওয়া ছাড়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *