বাবার কী অপরাধ ছিল—————— এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন

Slider বাধ ভাঙ্গা মত

৩ নভেম্বর সকালেই আমরা বাবার মৃত্যু সংবাদ পাই। মা অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে যে মানুষ কখনো হতোদ্যম হননি, সেই মানুষই বাবার মৃত্যু সংবাদে কেমন মুষড়ে পড়েন। এ সময় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী আর আত্মীয়স্বজনে ভরে যায় আমাদের বাড়ি। মা চাচ্ছিলেন বাবার লাশটা রাজশাহীতে এনে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করতে। কিন্তু খুনিদের দোসররা তাতে বাদ সাধে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভোর ৪টা। নিকষ কালো অন্ধকারে পিচঢালা পথ বেয়ে ছুটে চলেছে একটা জলপাই রঙের জিপ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্কিড করে দাঁড়িয়ে গেল জিপটা। লাফিয়ে নামল ৭-৮ জন কালো পোশাক মোড়া অস্ত্রধারী। কারারক্ষীদের গেট খোলার নির্দেশ দিল তারা। কারারক্ষীরা অনড়, ওপরের নির্দেশ ছাড়া তারা গেট খুলতে নারাজ। অগত্যা বঙ্গভবনে ফোন করল তারা। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে নির্দেশ পেয়ে গেট খুলে দিয়ে অস্ত্রধারীদের ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিতে বাধ্য হলো কারারক্ষীরা। ভেতরে ঢুকে তাদের আবদার অনুযায়ী জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমার বাবা এএইচএম কামারুজ্জামানকে ১ নম্বর সেলে একসঙ্গে জড়ো করার আদেশ দেওয়া হলো। অস্ত্রের মুখে বাধ্য হয়ে তারা সেই নির্দেশ তামিল করল। খুনি মোসলেম বাহিনী সেই ১ নম্বর সেলে ব্রাশফায়ারে নিভিয়ে দিল জাতির এই বীর সন্তানদের জীবন প্রদীপ। সেকেন্ডের ব্যবধানে হারিয়ে গেল বাংলাদেশের স্থপতিদের অন্যতম চার নেতার প্রাণ স্পন্দন। রেখে গেল একরাশ স্মৃতি।

শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ১৯২৩ সালের ২৬ জুন বর্তমান নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে আমার নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অর্থাৎ আমার দাদা আবদুল হামিদ ও দাদি মোছা. জেবুন্নেছা। বাবার দাদা ছিলেন রাজশাহী অঞ্চলের গুলাইয়ের জমিদার ও স্বনামধন্য সমাজসেবী হাজি লাল মোহাম্মদ। আট ভাই আর চার বোনের পরিবারে বাবা ছিলেন সবার বড়। দাদি শখ করে নাম রেখেছিলেন হেনা। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, তার প্রিয় নাতি হাসনাহেনা ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবেন। হ্যাঁ, সেই সৌরভের সাক্ষ্য আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। তার ব্যাপ্তি আরও বহুদূর পৌঁছাতে পারত। তবে পৌঁছাতে দেয়নি বিপথগামী ওই সেনারা- যারা রাতের আঁধারে তার প্রাণবায়ু ছিনিয়ে নিয়েছিল।

বাবা বেশ ধর্মভীরু ছিলেন। ছোটবেলায় আমরা তাকে নিয়মিত নামাজ আদায় ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখেছি। তিনি এত দ্রুত কোরআন তিলাওয়াত করতেন যে, তাকে কোরআনের হাফেজ বলা হতো। তবে পরের দিকে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তাকে আমরা বাসায় তেমন দেখতে পেতাম না। যতক্ষণ বাসায় থাকতেন, সর্বক্ষণ নেতাকর্মীদের দ্বারা সন্নিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ফলে আমরা তেমন সঙ্গই পেতাম না। আমরা সব ভাইবোনই বেশ মিস করতাম তাকে।

দাদা আবদুল হামিদ মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং দীর্ঘদিন রাজশাহী অঞ্চলের মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য (এমএলএ) হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দাদার বাড়িতে শেরেবাংলা একেএম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী থেকে শুরু করে বড় বড় নেতার সমাবেশ ঘটত। সেই পরিবেশ থেকেই বাবার রাজনীতির হাতেখড়ি। ফলে আইন পাস করার পর কোনো পেশাতেই তিনি নিয়োজিত হতে পারেননি। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৫১ সালে বাবা আমার মা জাহানারা বেগমের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। আমার নানার বাড়ি বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল গ্রামে। আমার নানা আশরাফ উদ্দিন তালুকদার ওই অঞ্চলের জোতদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমার ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমি চতুর্থ ও ভাইদের মধ্যে বড়।

বাবা অত্যন্ত নরম স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তাই বলে আমরা তাকে ভয় পেতাম না, এমন নয়। তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমাদের ছিল না। কোনো অপরাধ করলে শুধু নাম ধরে ডাকলেই আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। বাবার বড় ও ছোট মেয়ে খুব প্রিয় ছিল। বড় আপা পলিকে বাবা বেশ ভালোবাসতেন। তবে আমরা বাবার সঙ্গ খুব বেশি পাইনি। কেননা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় সব সময় নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে থাকতেন। তখন আমাদের খুব রাগ হতো। মায়ের সংস্পর্শেই আমরা বড় হয়েছি। আমার মায়ের বেশ ধৈর্য ছিল। তিনি বাবার রাজনৈতিক সঙ্গীদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। মায়ের ওই উদারতা ও সহায়তা না থাকলে বাবার পক্ষে এত বড় নেতা হওয়া হয়তো সম্ভব ছিল না। এ কারণেই কথায় বলে, প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে কোনো না কোনো নারীর হাত আছে। এ কথাটা আমার মায়ের ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রযোজ্য বলে আমাদের মনে হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার ৯ মাস ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ তিনি যে কষ্ট শিকার করে দিন কাটিয়েছেন, সেটি সম্ভব না হলে বাবার পক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব হতো কিনা বলা মুশকিল।

বাবা ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে তিনি প্রথম নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও তার পিতা আবদুল হামিদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে এক চমকপ্রদ ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। ওই ঘটনাটা তখনকার দিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আজও অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আমার দাদা আবদুল হামিদ রাজশাহী অঞ্চল থেকে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে তার ছেলে কামারুজ্জামান নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে আবদুল হামিদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। বাবা জানতেন, পিতা প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তার পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই তিনি মায়ের কাছে আবদার করলেন, বাপজানকে বুঝিয়ে যেন তিনি নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেন। অগত্যা আবদুল হামিদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। নির্বাচনী এলাকা সফরে গিয়ে ভিন্ন চিত্র প্রত্যক্ষ করলেন আমার বাবা। এলাকার মুরুব্বিদের বক্তব্য হলো, দীর্ঘদিন মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন করে অভ্যস্ত বিধায় তারা হেরিকেন (মুসলিম লীগের নির্বাচনী প্রতীক) ছাড়া অন্য কোনো মার্কায় ভোট দিতে পারবেন না।

আবদুল হামিদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বাবাকে দায়ী মনে করে তারা তাকে সমর্থন দেওয়া থেকে বেঁকে বসলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা বহু চেষ্টা-তদবির করে অন্তত একটা জায়গায় রফা করতে সমর্থ হলেন যে- আবদুল হামিদ সাহেব যদি এলাকায় এসে তার পক্ষে ভোট চান, তা হলে তারা বাবাকে ভোট দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন; অন্যথায় নয়। অগত্যা বাবা তার বাপজানের কাছে কথাটা বলতে সাহস না পেয়ে মায়ের কাছে বায়না ধরলেন, পিতা যেন তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু আবদুল হামিদের কাছে কথাটা বলতেই তিনি প্রচ- রেগে গেলেন। একটা দলের সভাপতি হয়ে তিনি অন্য দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না- সে যেই হোক, এটা তার সাফ কথা। বাবা হতাশ হয়ে এক রকম প্রচার বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকলেন। পিতার সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়, এটা তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলেন। তাই মাঠে গিয়ে লাভ কী? এ জন্য জানিয়ে দেন, পিতা তার পক্ষে কাজ না করলে তিনি আর নির্বাচন করবেন না।

এভাবেই কিছুদিন চলে গেল। সত্যি সত্যিই ছেলে নির্বাচনী কাজে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকায় পিতা আবদুল হামিদ নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছেলের জীবনের প্রথম নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় তিনি নিজেও বিচলিত হয়ে পড়লেন। অগত্যা রাজশাহী জেলার মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাটোরের মধু চৌধুরীকে ডেকে তিনি তার হাতে দলের সভাপতি ও সাধারণ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগের আবেদনপত্র দুটি ধরিয়ে ঘটনা খুলে বললেন। পরে পুত্রের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেমে তাকে বিজয়ী করতে সক্ষম হলেন। বাবার সেই বিজয় প্রথম হলেও আর কখনো তিনি কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি।

আমার বাবা তার আদর্শভিত্তিক নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির কারণে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই ১৩ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনেই কখনো পরাজিত হননি। এটা সম্ভব হয়েছিল তার অসাধারণ কর্মদক্ষতা, অপূর্ব সাংগঠনিক তৎপরতা আর চূড়ান্ত রাজনৈতিক সততার কারণে। এ জন্যই তিনি রাজশাহীবাসীকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে শামিল করেছিলেন। তার এ দক্ষতা ও যোগ্যতাই তাকে তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতির মতো দলের সর্বোচ্চ পদে সমাসীন করেছিল।

কী অপরাধ ছিল আমার বাবার- যার জন্য তাকে হত্যা করা হলো? এর জবাব কে দেবে? মাত্র ৫২ বছরের জীবনে যিনি অর্ধেকটাই কাটিয়েছেন আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অন্যান্য জাতীয় নেতাসহ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কাজে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, নিজের স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকানোর ফুরসত পাননি তিনি- সেই মানুষকে কোন অপরাধে হত্যা করা হলো? তা আমাদের অবোধগম্যই রয়ে গেল। জীবনের অনেক না জানা কথার মতো এখনো আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেল আমার বাবার অপরাধ কী?

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন : মেয়র, রাজশাহী সিটি করপোরেশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *