ঢাকায় ঘণ্টায় এক তালাক

Slider লাইফস্টাইল


ঢাকা: সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বনিবনা না হলে বিবাহিত নারী-পুরুষেরা আলাদা থাকছেন কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানেরা।

ঢাকা শহরে তালাকের আবেদন বাড়ছে। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। গত ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তালাকের আবেদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়-প্রায় ৭৫ শতাংশ। দক্ষিণ সিটিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। দুই সিটিতে আপস হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশের কম।

গত ছয় বছরে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অর্ধলাখের বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। এ হিসাবে মাসে গড়ে ৭৩৬ টি, দিনে ২৪ টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে।

তালাকের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’। স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। আর স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামী।

তালাকের প্রবণতা সারা দেশের হিসাবেও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে। গত জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ফলাফলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, গত বছর ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রতি এক হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ১ দশমিক ৪টি তালাকের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে যা ছিল ১ দশমিক ৫। বর্তমানে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি তালাক হয় (২ দশমিক ৭)। আর সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে (দশমিক ৬)।

এই বিষয়ে বিবিএসের ওই জরিপ প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম আশরাফুল হক বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়টি নেতিবাচকভাবে না দেখে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। বিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বনিবনা না হলে তাঁরা আলাদা থাকছেন কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তবে তালাকের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানেরা। প্রায় তিন বছর আগে নির্যাতনের শিকার এক নারী স্বামীকে তালাক দেন। রাজধানীতে বসবাসকারী ওই নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, স্বামীর প্রচুর টাকা ছিল কিন্তু স্ত্রী ও সন্তানদের কোনো ভরণপোষণ দিতেন না। নেশা করতেন। হত্যা মামলার আসামি। শারীরিক নির্যাতন করতেন। স্বামীকে কয়েকবার তালাক দিতে চান, কিন্তু গুন্ডাপান্ডা দিয়ে মা-বাবা, ভাইদের মেরে ফেলার হুমকিতে তিনি থেমে যান। অবস্থা বেশি খারাপ হলে দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। তারপর স্বামীকে তালাক দেন।

বর্তমানে এই নারী রাজধানীতে টিউশনি করেন। তিনি বলেন, তালাকের পরও তিনি নানা ধরনের হুমকি-ধমকি পাচ্ছেন। স্বজনসহ তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন আগের স্বামী।

দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাকের আবেদন বাড়ছে। উত্তর ও দক্ষিণে তালাকের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে। অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধনমুক্ত থাকার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণে উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান ও বনানীর অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারীরা বেশি তালাকের আবেদন করছেন। আবার দক্ষিণ সিটিতে মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার এলাকায় পেশাজীবী নারীরা বেশি তালাক দেন।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে একজন নারী চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসক স্বামীকে তালাক দিয়েছেন বিয়ের এক বছরের মাথায়। বিয়ের পর স্ত্রী স্বামীর শারীরিক অক্ষমতার কথা জানতে পারলেও প্রথম দিকে তা সবার কাছে গোপন করেন। কিন্তু এ সমস্যার পাশাপাশি স্ত্রীকে আর উচ্চশিক্ষার সুযোগ না দেওয়া, ঘরের সব কাজ করতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন নির্যাতন চলতে থাকে। পরে মা-বাবার উদ্যোগে ওই নারী স্বামীকে তালাক দেন।

দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে মেয়ে তালাকপ্রাপ্ত হলে পরিবারে আশ্রয় পেতেন না। এখন সচেতনতা বাড়ায় মেয়েকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরিবারগুলোই এগিয়ে আসছে।

উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা উপসচিব অজিয়র রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তালাক নিয়ে সেভাবে গবেষণা নেই। তবে তালাক আবেদনের আগেই দুই পক্ষ মোটামুটি তালাক কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। ফলে আপসের জন্য আসা দম্পতির সংখ্যা খুব কম।

২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভাগ করা হয়। বর্তমানে দুই করপোরেশনে প্রথমে মেয়রের কার্যালয়ে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত হয়। তারপর সেখান থেকে তালাকের আবেদন মূলত স্ত্রী কোন অঞ্চলে বসবাস করছেন, সেই অনুযায়ী ওই অঞ্চলের কার্যালয়ে দেওয়া হয়। দুই পক্ষের মধ্যে তালাক আপস না হলে সিটি করপোরেশনের আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপসের বা তালাক প্রত্যাহারের আবেদন না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রবণতা হলো নারীরা সহজে তালাকের সিদ্ধান্ত নেন না। বাংলাদেশে নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের আবেদন কেন বাড়ছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের মতামত ছাড়া কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে বেশি বয়সী লোকের সঙ্গেও অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে এ ধরনের বিয়েগুলো টিকছে না।

বর্তমানে অনেক নারী বাইরে কাজ করছেন। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাইরে কাজের পাশাপাশি ঘরের সব দায়িত্বও নারীকে সামলাতে হচ্ছে। দ্বৈত ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একপর্যায়ে নারীরা হাঁপিয়ে পড়ছেন। আর নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে তালাকের মতো সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হচ্ছে। যে কারণেই তালাকের সংখ্যা বাড়ুক তা পরিবার, বিশেষ করে সন্তানদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বাবা-মায়ের মধ্যে তালাক হলে সন্তানেরা অস্থিরতার মধ্যে বড় হয়, যার প্রভাব বইতে হয় সারাজীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *