মালয়েশিয়ায় ১সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ

Slider টপ নিউজ

ঢাকা: একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেল।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটির বৈঠকে ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কুয়ালালামপুর থেকে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ১৪ আগস্ট মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে বিদেশি শ্রমিক ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিশেষ কমিটির বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মালয়েশিয়া ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে।

জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার গতকাল শনিবার বিকেলে বলেন, ‘মালয়েশিয়া শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ২১ আগস্ট আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে।’

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগে সংঘবদ্ধ চক্রের যুক্ততা আর বাড়তি টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। ফলে মালয়েশিয়া যে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে, তার আভাস ছিল।

বৈদেশিক কর্মসংস্থানে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ গত কয়েক বছরে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পরের স্থানটি মালয়েশিয়ার। তাই এ বাজার বন্ধ হওয়াটা দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কুয়ালালামপুর থেকে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ২১ আগস্ট বাংলাদেশকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের সরকারের মধ্যে ২০১৫ সালের ২৬ আগস্টের ঐকমত্য অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ বা বাতিলের অধিকার মালয়েশিয়ার রয়েছে। সে অনুযায়ী মালয়েশিয়া শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়োগ বন্ধের এ সিদ্ধান্ত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। শ্রমিক নিয়োগের বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দুই দেশের মন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বন্ধের পক্ষে মাহাথিরের যুক্তি

মালয়েশিয়ার দৈনিক নিউ স্ট্রেইটস টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছে, বিদেশি শ্রমিক ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিশেষ কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি সে সময় বলেন, জনশক্তি রপ্তানিতে একতরফা ভেঙে দেওয়া এবং লোক পাঠানের খরচ কমাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখন শুধু ১০টি এজেন্সি বাংলাদেশের লোকজনকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারে। এটি একধরনের একচেটিয়া প্রক্রিয়া।

এই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়ার প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ব্যবসাটিকে বাংলাদেশের সব এজেন্টের জন্য খুলে দিতে চাই। এতে করে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়বে, জনশক্তি রপ্তানির খরচ কমবে। বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারে একটি অভিন্ন পন্থা অনুসরণ করা হবে। এ জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা সাবেক মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। কমিটি শ্রমবাজারের বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।’

জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক সভাপতি বেনজির আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, মালয়েশিয়ায় ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাজার স্থগিতের কথা শুনিনি। মালয়েশিয়ার সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা আমাদের জনশক্তির বাজারের জন্য বিরাট ক্ষতি হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, মালয়েশিয়ার সরকার ভবিষ্যতে শুধু ১০টি এজেন্সি নয়, বাংলাদেশের সব এজেন্সির জন্য মালয়েশিয়ার বাজার উন্মুক্ত করবে।’

জুনের স্থগিতাদেশ

সংঘবদ্ধ চক্রের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে জুন মাসে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর চলতি পদ্ধতি বন্ধের ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া। ২০১৬ সালে মালয়েশিয়া যেতে নতুন পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল। তাতে সে দেশে অভিবাসন শ্রমিক পাঠাতে বাংলাদেশের ১০টি এজেন্সিকে মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারণ করে দেয়। এর আগে বাংলাদেশ থেকে যেকোনো রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারত। এই প্রক্রিয়ায় গত দেড় বছরে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া গেছেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩০ জন। জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা ধরলেও তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৬৭৩ কোটি টাকা। এই হিসাবে সিন্ডিকেটটি ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে দেড় বছরে।

এই চক্রে বাংলাদেশের ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান (রিক্রুটিং এজেন্সি) এবং মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানি রয়েছে। তারা হলো ইউনিক ইস্টার্ন ক্যারিয়ার ওভারসিজ, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ।

বায়রার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় এই চক্রের প্রধান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশীয় নাগরিক মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুন নূর। আমিন এবং ওই দেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজমি খালিদ, শ্রম বিভাগের সাবেক পরিচালক টেংকু ওমরসহ কয়েকজন প্রভাবশালী মিলে সিনারফ্ল্যাক্স নামে একটি কোম্পানি তৈরি করেন। এই কোম্পানিকেই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়ার দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়ার সরকার। তারা বাংলাদেশের নির্দিষ্ট ১০ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করত।

রপ্তানির পরিসংখ্যান

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই অর্থাৎ প্রথম সাত মাসে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৩৬ জন বাংলাদেশি কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। তাঁদের মধ্যে শুধু সৌদি আরব আর মালয়েশিয়ায় ১ লাখের বেশি শ্রমিক গেছেন। এ সংখ্যা যথাক্রমে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫৭৭ ও ১ লাখ ৯ হাজার ৫৬২। এ ছাড়া ২০১৭, ২০১৬ ও ২০১৫ সালে মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯৯ হাজার ৭৮৭, ৪০ হাজার ১২৬ এবং ৩০ হাজার ৪৮৩।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *