অবশেষে সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধার

Slider জাতীয়

image_109853_0সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি তেল নিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজটি টেনে তীরে নিতে পেরেছে মালিকপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে জাহাজটিকে দেশীয় পদ্ধতিতে তীরে টেনে আনা হয়। গত মঙ্গলবার ভোরে ফার্নেস তেলবাহী ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ অপর একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া তেলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সুন্দরবন।

ডুবে যাওয়া তেলবাহী জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মের্সাস হারুণ অ্যান্ড কোং এর ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন জানান, তিনটি কার্গো জাহাজ ও স্থানীয় ডুবুরিদের সহায়তায় দেশিয় পদ্ধতিতে ডুবন্ত জাহাজটিকে তারা তীরের দিকে টেনে নেন। সন্ধ্যার মধ্যেই এটিকে খুলনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদ জানান তিনি।

ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধারে নারায়ণগঞ্জ ও বরিশাল থেকে গত মঙ্গলবার রাতে প্রত্যয় ও নির্ভীক নামের দুটি জাহাজ রওনা দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা। জাহাজগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে কিনা জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর খুলনার নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের উপ পরিচালক মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সকাল ১১টায় বলেন, “প্রত্যয় পথে আছে। নির্ভীক কোথায় আছে জানতে পারছি না।”

মংলা বন্দরের বোর্ড সদস্য কমোডর এম শাহজাহান সকালে জাহাজ উদ্ধার ও পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলা সংক্রান্ত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রওনা হওয়া জাহাজ কান্ডারি-১০ হিরণ পয়েন্টে পৌঁছে গেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজটি উদ্ধারকাজ শুরু করতে পারবে বলে তিনি জানান।

এম শাহজাহান আরও জানান, জাহাজটিতে ১০ হাজার লিটার তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম রাসায়নিক ‘ওয়েল ডিসপারসেন্ট’ রয়েছে। কান্ডারি-১০ থেকে এই রাসায়নিক ছিটিয়ে দেওয়া হবে পানিতে ভাসমান তেলের ওপর। তবে উদ্ধারের পর জাহাজের ট্যাংকার থেকে কতখানি তেল বের হয়ে গেছে তা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেননি এম শাহজাহান।

গত মঙ্গলবার ভোরে ফার্নেস তেলবাহী ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ অপর একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ঘটনায় সুন্দরবনের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা অনুসন্ধানে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল শিগগিরই বাংলাদেশে আসতে পারে।

বুধবার পর্যন্ত জাহাজটি উদ্ধার কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণে তেল অপসারণের তৎপরতা শুরু হয়নি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রওনা হয় কান্ডারি-১০ নামের একটি জাহাজ। সেটি পৌঁছানোর আগেই দেশিয় পদ্ধতিতে জাহাজটি উদ্ধার করা সম্ভব হলো।

তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। এ ছাড়া সুন্দরবন ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দুই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর এ এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। বন বিভাগ থেকে একাধিকবার এবং জাতিসংঘের জলাভূমিবিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞান-শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো থেকে নৌপথটি নিয়ে আপত্তি তুলে তা বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস বুধবার এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের জন্য সরকারের কাছে আবারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ধরনের বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চললে তা দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে।

পলিন টেমেসিস আরও বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকাটিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে বিশ্বের বিপদাপন্ন দুই প্রজাতি গাঙ্গেয় ও ইরাবতি ডলফিনের বিচরণ। এ ছাড়া অনেক সমৃদ্ধ জলজ প্রাণী রয়েছে সেখানে। সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। তাই সুন্দরবনের ভেতরে এই দুর্ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সুন্দরবনের ভেতরে জাহাজডুবিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে তার সুরক্ষার পরিবর্তে বনটির ভেতর দিয়ে বড় নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য যথেষ্ট যে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও তা কতটা অরক্ষিত এবং এর নিকটবর্তী নদী দিয়ে তেল, কয়লা বা বিষাক্ত বর্জ্য পরিবহন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ এবং এর পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তার কিছুটা লক্ষণ এই দুর্ঘটনা থেকে দেখা গেল। সরকার এখনই যদি নৌপথ বন্ধ না করে এবং রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের পাশ থেকে সরিয়ে না নেয়, তাহলে আমরা সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাব তো বটেই, একসময় বনটিই ধ্বংস হয়ে যাবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *