সিলেটে আরিফুল হক আবার মেয়র নির্বাচিত

Slider জাতীয় সিলেট

সিলেট: নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে মেয়র নির্বাচিত হলেন বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। সব শঙ্কা উড়িয়ে ছয় হাজারের বেশি ভোট পেয়ে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মেয়র নির্বাচিত হলেন। তার কাছে ধরাশায়ী হলেন সিলেট আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। বিজয়ের পর আরিফুল হক চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ার জানিয়েছেন- নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সিলেটের উন্নয়ন ঘটাবেন। সব পেশার মানুষের মতামত নিয়ে তিনি তার ঘোষিত আধুনিক সিলেট গড়ার কাজে মনোনিবেশ করবেন। আর পরাজিত প্রার্থী কামরানও নতুন মেয়রের উন্নয়নে সাহায্যের হাত প্রসারিত থাকবে বলে জানান।

৩০শে জুলাই নানা অঘটনের ভোট হয়েছে সিলেটে। কেন্দ্র দখল, জালভোটসহ নানা ঘটনার কারণে ওই দিন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা যায়নি। স্থগিত করা হয়েছিল সিলেটের ২৪নং ওয়ার্ডের গাজী বুরহান উদ্দিন গরম দেওয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২৭নং ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র।

এই দুই কেন্দ্রে ভোট ছাড়াই আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরানের চেয়ে চার হাজার ৬২৬ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। জয়ের জন্য আরিফের প্রয়োজন ছিল ১৬২ ভোট। এই ভোটের জন্য গতকাল সিলেটের স্থগিত ওই দুটি কেন্দ্রে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপরও এই দুটি কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। ৩০১ মৃত ও প্রবাসী ভোটার চিহ্নিত করে তিনি আগেভাগেই বিজয়ী ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী নির্বাচন করেই গতকাল তাকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। মোট ১৩৪টি কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৮৮ ভোট। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৮৬ হাজার ৩৯২ ভোট। ছয় হাজার ১৯৬ ভোটে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আলিমুজ্জামান বিজয়ী মেয়র হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেন। আর এই নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে সিলেটে বিজয় উল্লাস করেন বিএনপি সমর্থকরা।

নগরীর রোজভিউ হোটেলের সামনে থেকে মিছিল সহকারে আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়া হয় তার কুমারপাড়াস্থ বাসভবনে। এই বিজয়কে কষ্টের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেন তারা। বলেন- নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে নিতে সরকার ও আওয়ামী লীগ সব চেষ্টাই করেছে। কিন্তু জনগণের ভোট বিপ্লবের কারণে বিজয় ছিনতাই করা সম্ভব হয়নি। ওদিকে ভারি বর্ষণ। থামার কোনো লক্ষণ নেই। মাঝে মাঝে বজ্রপাতও হচ্ছে। এ রকম বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই সকালে সিলেটের স্থগিত দুটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। নির্বাচনী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি সকালে। সময় যত গড়ায় বৃষ্টি তত বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে আশঙ্কাও। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। মাঝে মধ্যে দু’একজন ভোটার এসে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। গুমোট আবহাওয়ার মধ্যেও সতর্ক ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভোটার ছাড়া কাউকেই তারা কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। সকাল তখন সাড়ে ১০টা। নগরীর ২৪নং ওয়ার্ডের বুরহান উদ্দিন গরম দেওয়ান প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র। বৃষ্টির মাত্রা তখন কম। মহিলা ভোটাররা আসতে শুরু করেছেন। ছাতা মাথায় নিয়ে তারা এসে কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকেন। একজন, দুইজন করে বাড়ে ভোটারের সংখ্যা। ২০ থেকে ২৫ জন ভোটারের দেখা মিললো এ কেন্দ্রে। বাইরে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির কড়া পাহারা। ভেতরে শান্তভাবেই চলছে ভোটগ্রহণ। এ সময় বাইরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাউন্সিলর প্রার্থী রিপন ও সুহিন। তাদের সঙ্গে কর্মী সমর্থকদের ভিড় বাড়ছে। সেই সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠছে কেন্দ্রের বাইরের এলাকাও। কুশিয়াঘাট পয়েন্ট বাজারেও স্থানীয় ভোটাররা এসেছেন। এরই মধ্যে বেলা ১১টা নাগাদ বৃষ্টি প্রায় পুরোপুরি কমে আসে।

এমন সময় নিজের গাড়ি নিয়ে সেখানে হাজির সিলেট সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। গাড়ি থামতেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এসে জড়ো হন। কামরান সবাইকে ভোটকেন্দ্রের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যান ভেতরে। ওই কেন্দ্রে ৬টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছিল। ইতিমধ্যে মহিলা ভোটারের উপস্থিতি বেড়েছে। প্রায় সব কক্ষে ঢুঁ মারলেন কামরান। মহিলা ভোটারের সঙ্গে কথা বললেন। ভোট দিতে এসে কোনো সমস্যা হচ্ছে কী না জানতে চাইলেন তাদের কাছে। বললেন- ভোট যেন শান্তিপূর্ণ হয়। প্রায় তিন মিনিট কামরান ওই কেন্দ্রের বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, সিলেটের স্থগিত এ দুটি কেন্দ্রে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে মহিলা ভোটাররা এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিচ্ছে। সঙ্গে আছে পুরুষ ভোটাররাও। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে সব ভোটই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও এক্ষেত্রে প্রশংসার দাবি রাখে। কামরান বলেন, নির্বাচনে যে ফলাফলই হবে আমরা তা মেনে নেব। আর যেই নির্বাচিত হন তাকে শুভেচ্ছা জানাবো। আগামীতে সিলেটের উন্নয়নে তার হাত প্রসারিত থাকবে বলেও জানান। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজও উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেই ২৭নং ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যান কামরান।

কুশিঘাট থেকে কামরান চলে যাওয়ার প্রায় পাঁচ মিনিটের মাথায় সেখানে পৌঁছেন বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবনসহ নেতারা। আরিফ মাত্র দুই নেতাকে সঙ্গে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে ঢুকেন। এ সময় তিনি ঘুরে ঘুরে সব কটি কক্ষ দেখেন। ভোটারের সঙ্গে কথাও বলেন। বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, এই ভোট নিয়ে অনেক শঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত ভোটাররা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিচ্ছেন। আরিফ বলেন, নির্বাচিত হলে সিলেটের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে কাজ করবো। সব শ্রেণি পেশার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নগরকে সাজাবো। তিনি সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার সব ভোটারকেও ধন্যবাদ জানান। কামরানের মতো আরিফও কুশিঘাট কেন্দ্র পরিদর্শন করে হবিনন্দি কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। বেলা তখন ১২টা। নগরীর ২৭নং ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই পুলিশের চেকপোস্ট। দুই সারির সড়কের একাংশে পুলিশের ব্যারিকেড। বাইরে পুলিশ ও র‌্যাবের কড়া পাহারা। টহলে আছে বিজিবি। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার পরও কেন্দ্রের অনতিদূরে শ’দুয়েক এলাকাবাসী দাঁড়িয়ে। কেন্দ্রের প্রধান ফটকে গেলে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্য, সাংবাদিক ছাড়া কেন্দ্রে আর কেউ নেই। দু’একজন ভোটার আসছেন। তারাও নীরবে ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। বেলা ১টার দিকে প্রিসাইডিং অফিসার জানিয়েছেন, ৫০ ভাগ ভোট কাস্ট হয়ে গেছে।

কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে ভোটাররা আসছেন। তবে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হওয়ার কারণে কোনো জটলা নেই কেন্দ্রে। দুপুরের পর ভোটকেন্দ্রের নিচ তলায় কাউন্সিলর প্রার্থী অ্যাডভোকেট রোকশানা বেগম শাহনাজ ও আসমা বেগম পায়চারী করছিলেন। খানিক পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কেন্দ্রের প্রধান ফটকে নিয়ে আসে। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন কাউন্সিলর প্রার্থী আযম খানও। বেলা ২টার দিকে কেন্দ্র পরিদর্শনে যান সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি তখন সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বর্তমান সরকার শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণে বিশ্বাসী। সিলেটে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। সকালে কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সিলেট জেলা সিনিয়র নির্বাচনী কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সকালের দিকে বৃষ্টি থাকায় ভোটাররা কম ছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি বাড়ে। নির্বাচনে যাতে কোনো গোলযোগ না ঘটে সে কারণে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরি করা হয়। এর আগে কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষ জানান, সিলেটের ভোট গ্রহণকারী ১৬ কেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়েছে। চার স্তরের নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। এদিকে, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ১৯, ২০ ও ২১নং ওয়ার্ডে মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোটগ্রহণ করা হয়। তবে, ওই তিন ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোতে দুপুরের পর থেকে ভোটারের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। সুনশান নীরব ছিল বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্র। এদিকে, ফলাফলে ১৯, ২০ ও ২১নং ওয়ার্ডে নির্বাচিত হয়েছেন নাজনীন আক্তার কনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *