বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ

Slider জাতীয়

317806_138

এক দিন বিলম্বে গতকাল শুক্রবার রাতে মহাশূন্যে যাত্রা করেছে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। রাত ২টা ১৪ মিনিটে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ডানা মেলল মহাকাশে। যুক্তরাষ্ট্রের ফোরিডাস্থ উৎপেণ স্টেশন থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরের নিজস্ব কপথে ছুটে গেলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১।
উৎপেণ অনুষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিটিভি ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। দেশব্যাপী মাঠ পর্যায়েও বাংলাদেশের সাফল্যের এই দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে মাঠ প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ দেশটির ফোরিডার কেপ কেনাভেরাল লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎপেণ করে। স্যাটেলাইট উৎপেণে ব্যবহার হয় একটি ফ্যালকন-৯ ব্লক ফাইভ রকেট।
এর আগে গত ৪ মে ফোরিডার কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারে নতুন এই রকেটের পরীামূলক উৎপেণ সম্পন্ন হয়।
গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎপেণের কথা থাকলেও ফোরিডায় ‘ইরমা’ ঝড় এবং প্রতিকূল আবহাওয়াজনিত কারণে কয়েক দফা পিছিয়ে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় বৃহস্পতিবার। কিন্তু সেদিনও উৎপেণের ৪২ সেকেন্ড আগে তা একদিনের জন্য স্থগিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বিদেশী এবং বাকি ১ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ‘স্যাটেলাইট সিস্টেম’ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায় ‘স্যাটেলাইট সিস্টেম’ কিনতে ফ্রান্সের থালেস এলিনিয়া স্পেসের সাথে চুক্তি করে বিটিআরসি।
স্যাটেলাইট উৎপেণে অর্থায়নের জন্য এইচএসবিসি ব্যাংকের সাথে গত বছর প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার।
মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্য থেকে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে স্যাটেলাইট নিয়ে মহাকাশ যানটি উৎক্ষেপণের কথা ছিল। কিন্তু উৎক্ষেপণের মাত্র ৪২ সেকেন্ড আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থগিত হয়ে যায় উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পিউটারে স্থগিত বার্তা আসে। গ্রাউন্ড সিস্টেমের ত্রুটির কারণে এ ঘটনা ঘটে। ফলে স্যাটেলাইট আকাশে ওড়া তখন স্থগিত করা হয়।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ গত বৃহস্পতিবার রাতে হিলটন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, উৎক্ষেপণ যান বা রকেট ঠিক ছিল, স্যাটেলাইটও ঠিক ছিল। উৎক্ষেপণের ঠিক আগ মুহূর্তে গ্রাউন্ড সিস্টেমে সমস্যা হওয়ার বার্তা আসায় আকাশে উড়তে পারেনি স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১।
তিনি বলেন, উৎক্ষেপণের পুরো বিষয়টি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। কম্পিউটার ইতিবাচক সঙ্কেত না দেয়ায় উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়। শুক্রবার নির্ধারিত সময়ে উৎক্ষেপণের চেষ্টা করা হবে। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের সময় বিকেল ৪টা ১৪ মিনিটে তথা বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিটে থেকে পরবর্তী দুই ঘণ্টায় আবার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চেষ্টা করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উপস্থিত ছিলেন।
স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম স্পেসএক্স। বৃহস্পতিবার রাতে মহাকাশ যানটি উৎক্ষেপণ করতে না পারা বিষয়ে স্পেসএক্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া এক মিনিট আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থমকে যেতে হয়েছে। স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী এলন মাস্ক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। উৎক্ষেপণের দুই ঘণ্টা আগেই তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন উৎক্ষেপণের ত্রুটির কথা। তিনি বলেছিলেন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতে পারে।
স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ নিয়ে মহাকাশে যাত্রা করবে যে মহাকাশ যান বা রকেট তার নাম ফ্যালকন-৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হবে। উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়াটি সরাসরি সম্প্রচারের কথা রয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনায় নবগঠিত কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার রাতে জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে রওনা হওয়ার প্রথম দুই ঘণ্টার মধ্যে ফ্যালকন-৯ তিন শ’ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে। প্রথম ১০ থেকে ১২ ঘণ্টায় অতিক্রম করবে ৩৫ হাজার কিলোমিটার পথ। উৎক্ষেপণ যানটি তিন হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করার পর থেকেই গাজীপুরে অবস্থিত ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে সেটির অবস্থান দেখা যাবে। এ সময় এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ কাজ শুরু হবে। পরবর্তী সময়ে এটি পরিচালনাও করবে এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। স্যাটেলাইটটি কক্ষপথে পৌঁছাতে সময় লাগবে আট থেকে ১০ দিন। তবে এটি পুরোপুরি কক্ষপথে স্থাপিত হয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার উপযোগী হতে সময় লাগবে কমপক্ষে দুই মাস।
স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ ‘কমিউনিকেশন ও ব্রডকাস্টিং’ ক্যাটাগরির। এটি যোগাযোগ ও সম্প্রচার কাজেই মূলত ব্যবহার করা হবে। এ স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। আর ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে ভাড়া দেয়ার জন্য রাখা হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বছরে অনেক টাকা আয় করারও সুযোগ রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল প্রতি বছর অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে এ অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ ব্যয়ও কমে আসবে।
এ ছাড়া স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ। এতে ব্যান্ডউইথের বিকল্প উৎসও পাওয়া যাবে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও উদ্ধারকর্মীরা স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ রেখে দুর্গত এলাকায় কাজ করতে সক্ষম হবেন। মহাকাশ গবেষণার প্রয়োজনে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহেও ব্যবহার করা যাবে এ স্যাটেলাইট।
১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রির অরবিটাল স্লটে বা নিরক্ষরেখায় উড়বে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। এ জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য অরবিটাল স্লট বা নিরক্ষরেখা (১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি) লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে এ স্লট বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের মালিক দেশগুলোর সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কেনেডি স্পেস সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, ডাক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ, বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার।
বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রবাসীরা যুক্ত হয় ফ্লোরিডায়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দা লাগানো হয় উৎক্ষেপণ দেখার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *