বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়া বা তাকে জেলে রেখে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। এ কারণে চেয়ারপারসনের মুক্তি তাদের প্রধান অ্যাজেন্ডা। তার মুক্তি প্রলম্বিত হলে মুক্তির আন্দোলনকে সামনে রেখে বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে চায়। এ কারণে বিএনপি জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচির ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
অন্য দিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করেন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পান বা না পান বিএনপি নির্বাচনে আসবে। তার অনুপস্থিতি বিএনপিকে আরো দুর্বল করবে। তবে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতি যদি বাড়তে থাকে তাহলে তার রাজনৈতিক লাভ বিএনপি পাবে। ক্ষমতাসীন দল সেদিকে সতর্ক নজর রাখছে। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুরোপুরি বাধা না দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করার কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে আলোচনা করে দুই দলের রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন আইনি প্রক্রিয়াতে বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকবে। বিএনপি চেয়ারপারসনকে যে সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দণ্ড দেয়া হয়নি তা আন্তর্জাতিক মহলে স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেগম খালেদা জিয়ার সুষ্ঠুু বিচারের কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মুখপাত্র এক লিখিত প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এই বিবৃতিতে বলা হয় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাজার বিষয়টি আমরা সম্যক অবগত আছি। মামলার প্রক্রিয়াটি যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা খালেদা জিয়ার বিচার প্রক্রিয়ায় আইনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে বলা হয় আমরা আবারো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার এবং মুক্তভাবে মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপি নেতারা বলেছেন এই বিবৃতিতে এই বিচার যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে দিকে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতিসঙ্ঘ বেগম খালেদা জিয়ার বিচার প্রক্রিয়ার দিকে গভীর নজর রাখছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছে এই বিচারের আইনি দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তারা মনে করেন ভারতও এবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো কোনো নির্বাচন দেখতে চায় না। প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে পরিবর্তন ঘটছে তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে। ভারত এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেবে বলে মনে করে।
নির্বাচনে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা ও দেশের রাজনীতিতে ভারসাম্যমূলক অবস্থান গ্রহণের জন্য বেগম জিয়ার উপস্থিতি যে জরুরি সে দিকটি আন্তর্জাতিক মহল অনুধাবন করতে পারছে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বারিস্টার মওদুদ আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে বিএনপি আরো সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে। আগে রাজনীতির যে গতিধারা ছিল তা বদলে গেছে। তার মতে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি যতই বিলম্বিত হবে ততই সরকারের জনপ্রিয়তা কমবে। বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়বে। সে জন্য এটি একটি টার্নিং পয়েন্ট।
তিনি বলেন, বিএনপি আর এখান থেকে ফিরে যেতে পারবে না। বেগম খালেদা জিয়া দেশের মানুষের গভীর সহানুভূতি এরই মধ্যে অর্জন করেছেন। আগে বিএনপির অ্যাজেন্ডা ছিল একটাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। এখন তার সাথে যোগ হয়েছে বেগম জিয়ার মুক্তি।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু নয়া দিগন্তকে বলেন বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না; তাদের নেত্রী মুক্ত থাকবেন কি থাকবেন না তা সরকারের ওপর নির্ভর করে না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জেলে আছেন, তাতে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় আদালত তাকে পাঁচ বছরের জেল দিয়েছে। আপিল করলে জামিন হতেও পারে।
তবে তিনি মনে করেন বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল করেছে, সে রকম ভুল আর করবে না। তবে তিনি মনে করেন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার কারণে যদি সহানুুভূতি অর্জন করেন তাহলে বিএনপি রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারে।অবশ্য এখন পর্যন্ত সে রকম সহানুভূতি তিনি পাচ্ছেন বলে মনে করেন না আবদুল মতিন খসরু।
বেগম খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনের ব্যাপারে মত জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব:) সাখাওয়াত হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন নির্বাচনের ক্ষেত্রে দু’টি দিক রয়েছে। অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক। বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, বেগম জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি পারবেন না তা নির্বাচন কমিশন ও আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাপার। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তা খুব ভালো ফল বয়ে আনবে না। তাতে বিএনপি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।
অন্য দিকে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন আমাদের দেশের রাজনীতিতে নানা নীতিহীনতা চলছে। বিএনপি ভেঙে একটি অংশকে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে ক্ষমতাসীন দল। তবে মূল ধারার বিএনপি নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া প্রকৃত অর্থে কোনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপ প্রসঙ্গে দিলারা চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইলেও ভারতের ইচ্ছা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত কতটা এ দেশের জন-আকাক্সক্ষার দিকটি বিবেচনায় নেবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ দিতে পারে।
তা কতটা কার্যকর হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ঘটনা থেকে আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ দেশটি আমলে নিচ্ছে না। এ কারণে আভ্যন্তরীণ চাপ বা জনগণের চাপ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।