বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে…

Slider বাংলার মুখোমুখি

Untitled-43-5a81ef0ebdc9f

 

 

 

 

 

‘ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগল যে দোল।/স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল/দ্বার খোল, দ্বার খোল…।’ প্রকৃতির চারিপাশে লেগেছে দোলা। দখিনা হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, উৎরোল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, পল্লব মর্মরে, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে ওঠার আভাসে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে- ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…।’ অথবা কারও কারও হর্ষধ্বনি- ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন…।’

শীতের রুক্ষ, হিমেল দিনের অবসান ঘটিয়ে জেগে উঠল বসন্ত। আজ মঙ্গলবার সেই পহেলা ফাল্কগ্দুন। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময়তায় আজ ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী দিন। অভিন্ন এক অনুভূতিতে আজ ভাসছে ভাটিবাংলা থেকে সারাবাংলা- ‘বসন্ত বাতাসে সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ/আমার বাড়ি আসে।’ যে প্রাণখোলা বুনো আনন্দে একদিন দুলেছিলেন শাহ আবদুল করিম, সেই আনন্দ আজ সবার। উদ্বেল, ব্যগ্র হৃদয়ের মন্দিরে আজ দুলে দুলে উঠছে এই কামনা- ‘মধুর বসন্ত এসেছে, আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে…।’

আজকের পূর্ব আকাশের নবীন ঊষা, প্রভাতের নবীন ঊষা বাংলার প্রকৃতিতে নিয়ে এসেছে ঋতুরাজের দোলা। খুলে গেছে দখিনা দুয়ার। মানব-মানবীর হৃদয়ের বেদি আর প্রজাপতির রঙিন পাখা, মৌমাছির গুনগুনানি, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে, শাখায় শাখায়, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর অরণ্য-পর্বতে নবযৌবনের বান ডেকেছে। প্রকৃতির এই রূপতরঙ্গে দুলে উঠে কবিগুরু গেয়ে ওঠেন- ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’ শীতের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়া, বিবর্ণ জারুল-পারুল, মাধবী-মালতী-রজনীগন্ধা, পলাশ-জবা, কৃষ্ণচূড়া-দোপাটি, কনকচাঁপার গুচ্ছ আন্দোলিত হচ্ছে দখিনা বাতাসে নবজীবনের স্পন্দনে। আড়মোড়া ভেঙে বাতাসে হিল্লোর তুলছে আম-কাঁঠালের বাগান। বসন্ত-বন্দনা করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ‘হয়তো ফোটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যতো আছে/হয়তো গাহেনি পাখি, অন্তর উদাস করা সুরে/…তবুও ফুটেছে জবা, দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।’

গণমানুষের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন- ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক/আজ বসন্ত।’ শীতের রিক্ততা মুছে দিয়ে প্রকৃতিজুড়ে আজ সাজসাজ রব। হিমেল পরশে বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠছে নবীন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশ সোনাঝরা আলোর মতই হৃদয় আন্দোলিত। আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে…। ‘আহা, আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে/ কত পাখি গায়..।’ নব পুষ্পপত্র-পল্লবে, প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে উঠেছে।

বসন্তকে বলা হয় প্রেমের ঋতু। মাতাল করা নানা ফুলের সৌরভে মানব হৃদয়ে পূর্ণতা পায় প্রেমের অনুভূতি। বসন্ত যেন সব বাধা ভেঙে দিয়ে প্রিয়তমার হাত ধরে বলতে চায়- ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমাকে অশোকে-কিংশুকে/অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণে সুখ…।’ কিংবা শচীন-কর্তার মতো করে গেয়ে উঠবে- ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/প্রেমে পড়েছি আমি।’ অথবা প্রেমের দেবতা কিউপিটের ছোড়া তীরে বিদ্ধ প্রেমিক জুটি সূর্যের মুখে তাকিয়ে বলবে- ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব/তুমি আছো, আমি আছি।’

শুধু প্রাণের দুরন্ত আবেগ আর প্রেমে নয়, এ ঋতুতে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে দ্রোহে-প্রতিবাদে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো বার্তা ছড়ায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন…।’ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে বাংলার তরুণরা রক্ত ঝরিয়েছে এ ঋতুতে। আবার সামরিক-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও রক্ত ঝরিয়েছে এই বসন্তে। তাই দোসরা ফাল্কগ্দুন ‘সামরিক-স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্র দিবস’!

ফুলের মঞ্জরিতে মালা গাঁথার দিন বসন্ত কেবল প্রকৃতিকেই রঙিন করেনি, রঙিন করেছে আবহমান কাল ধরে বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রাণ। তাই আজ পহেলা ফাল্কগ্দুনের এ দোলা জাগানো দিনে তরুণীরা খোঁপায় গাঁদা-পলাশ ফুলের মালা গুঁজে বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে, তরুণরা পাঞ্জাবি-পাজামা কিংবা ফতুয়ায় খুঁজে নেয় শাশ্বত বাঙালিয়ানা। আজ তাই উৎসবের হাওয়ায় তরুণ-তরুণীদের ভাসতে দেখা যাচ্ছে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, টিএসসি আর অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ নগরের নানা স্থানে। এমনকি দূর মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে তারুণ্যের এই যাত্রা। ফোনে, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চলছে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়।

বসন্ত উদযাপন
বসন্তকে স্বাগত জানাতে ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’- এ প্রতিপাদ্যে আজ রাজধানীর চারটি মঞ্চে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ। যার মূল আয়োজনটি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। ভোর ৭টায় গিটারে দীপন সরকারের ‘বসন্ত বাহার’ যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ছনা দিয়ে শুরু হবে এ উৎসব। সকালের পর্ব চলবে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এরপর আবার বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একযোগে অনুষ্ঠান চলবে চারুকলার বকুলতলা, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্রসরণির উন্মুক্ত মঞ্চে।

রাজধানীর লালমাটিয়ার বেঙ্গল বই-এ আয়োজন করা হবে পহেলা ফাল্কগ্দুনের অনুষ্ঠান। থাকছে সানিডেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় কবিতা, সঙ্গীত ও নৃত্য। আরও থাকছে ঝিনাইদহের দিশারী নাট্যগোষ্ঠীর পরিবেশনায় যাত্রাপালা ‘অনুসন্ধান’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *