চাই শুভশক্তির আতশবাজির উৎসব

Slider বিচিত্র

c10c96e4589ac3196664a4aa331365f4-5a4efe0ea7d61

 

 

 

 

বছরের শেষ রজনী। তাই সন্ধ্যা থেকেই চারদিকে উচ্চস্বরে বেজে চলছিল ইংরেজি মিউজিক আর হিন্দি সিনেমার গান। কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসছিল একটা-দুটো পটকার শব্দ। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, রাত ১২টা বেজে ১ মিনিট। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার হঠাৎ গায়েব! চারদিকে পটকা আর আতশবাজির শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান। তারাবাতি আর আতশবাজির আলোয় রাতের আকাশে ফুটে উঠেছে বর্ণিল নকশা। প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে চলছে কেক কাটা আর ফানুস ওড়ানোর দৃশ্যের ফটোসেশন আর সেলফি তোলার উৎসব। এত আলো, এত আনন্দ, এত সংগীতের মূর্ছনা, এ তো নিত্যদিনের ঘটনা নয়। বছরে একবারই আসে এমন একটি রাত। সবার মনে তাই আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগেনি। হঠাৎ চোখ পড়ে গলির রাস্তার এক কুকুরের ওপর। বেচারা থার্টি ফার্স্ট নাইট বোঝে না। হঠাৎ এত শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে ঘুম নষ্ট হওয়ায় সে মহা বিরক্ত। ঘেউ ঘেউ শব্দ করতে করতে শরীর বাঁকিয়ে গলির পথ ধরে সে দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে। শুনেছি কুকুরের অনুভূতিশক্তি নাকি প্রবল। সে নাকি অনেক কিছুই আগে থেকে টের পেয়ে যায়। তাই মানুষ যখন আনন্দ আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করতে ব্যাকুল, তখন সেই অধম প্রাণীটি হয়তো ঠিকই বুঝতে পারে যে গত বছরের শেষ দিনটি আর নতুন বছরের প্রথম দিনটির মধ্যে বাস্তবিক অর্থে কোনো পার্থক্য নেই।

সামাজিক মাধ্যমের ওয়াল ভরে ওঠে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর উদ্ভাবনী শব্দশৈলী আর ছবিতে। শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দিতে মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ, ভাইবার আর টুইটারের দম ফেলার সময় নেই। অতঃপর রাত পার হয়। আসে নতুন বছরের নতুন সকাল। কিন্তু পরিবর্তন আসে না প্রতিদিনের রোজনামচার। নতুন বছরের সকালে সেই এক অফিস পরিবহন বাস, লেগুনা, উবার কিংবা পাঠাওতে চড়ে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে কর্মক্ষেত্রে হাজিরা দেওয়া। অফিসে পৌঁছে হাসি হাসি মুখে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে একে অন্যকে ’হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলার সৌজন্য রক্ষার আয়োজনে। সজোরে করতালিসহ কেক কাটা হয়। কিন্তু এত আয়োজনেও মিলিয়ে যায় না প্রতিদিনের অফিসপাড়ার রাজনীতি কিংবা কূটনীতির চেহারা। এমনকি ফটোসেশনকে কেন্দ্র করেও চলে স্বার্থসিদ্ধির নির্লজ্জ আয়োজন। মুখের ওপর লাগিয়ে রাখা মেকি হাসির আড়ালে চলে একে অন্যকে ল্যাং মারার প্রস্তুতি।

নতুন বছরের নতুন সকাল এনে দেয় না পলিথিন মোড়ানো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ক্রন্দনরত অসহায় শিশুটির মুখে হাসি, কিংবা শহরের বস্তিতে যেকোনো মুহূর্তে ধর্ষিত হওয়ার শঙ্কা নিয়ে রাত কাটানো কিশোরী মেয়েটির জীবনে সামান্যতম স্বস্তি। নতুন বছর নানা দাবিতে ধর্মঘট আর অনশনে থাকা শিক্ষকদের জন্য এনে দেয় না কোনো সুসংবাদ। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার বিসর্জন, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি যেমন চলছিল, ঠিক তেমনই চলতে থাকে। জানি না প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি এ বছর আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে কি না! কোচিং ও গাইড-বাণিজ্য চলবে হয়তো আগের মতোই। গণপরিবহনে পুরুষের অনাকাঙ্ক্ষিত হাত হয়তো একইভাবে স্পর্শ করে চলবে নারীর শরীর। হাজার হাজার মেয়েকে হয়তো বিয়ে দেওয়া হবে তাদের কৈশোর শেষ হওয়ার আগেই। গুম হবে মানুষ, তারপর তাদের নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে চলতে থাকবে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির নোংরা খেলা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হয়তো আরও নাকাল করবে ভোক্তাদের, তারকা পেঁয়াজ হয়তো ডাবল সেঞ্চুরি করে বসবে নতুন বছরে! রাজপথে বাড়বে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ। যানজট হয়তো দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর হবে আর সেই সঙ্গে দীর্ঘতর হবে সব মিলিয়ে মানুষের ভোগান্তির মাত্রা।

তারপরও আমরা নতুনকে ভালোবাসি। তাই নতুন আশায় বারবার বুক বাঁধি। এ বছর ইংরেজি নববর্ষের উৎসবকে কেন্দ্র করে ছিল বাড়াবাড়ি রকমের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আর নির্দেশনা। মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশি তল্লাশি আর প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু নিষেধের বেড়াজালে আটকে রাখা যায়নি মানুষকে। বরং মানুষের উল্লাস সশব্দে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো প্রকাশিত হয়েছে। রাতের আকাশ আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে, রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার হয়েছে। কিন্তু এই যে এত আলো, এত আয়োজন, তার সবই মেকি, সবই ক্ষণস্থায়ী। আতশবাজির আলোয় রাতের আকাশ ক্ষণিকের জন্য উদ্ভাসিত হয় বটে, তবে তা ঘনিয়ে আসা অন্ধকার, আমাদের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হতাশা দূরে সরাতে পারে না। তাই চাই মনের আলো, যে আলো দূরে সরিয়ে দেবে পৃথিবীর সব কালো, সব অন্ধকার। এই শুভশক্তির আলোই কেবল পারে আমাদের চারপাশের যা কিছু মেকি, যা কিছু অন্যায়, অশোভন তাকে সমূলে উৎপাটন করে একটি সুন্দর আলোকিত আগামী উপহার দিতে। সেই শুভশক্তির আতশবাজির উৎসব আর কত দূরে?

নিশাত সুলতানা: কর্মসূচি সমন্বয়ক, জেন্ডার জাস্টিস ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *