‘যার বিয়ে তার খোঁজ নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই’। শুনতে যেমনই হোক, এটাই বাস্তব এবং স্বাভাবিকও। কারণ, বিয়ে দুজন মানুষকে এক করলেও তা মূলত একটি সামাজিক স্বীকৃতি। সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার গঠনের স্বীকৃত পদ্ধতি বিয়ে। যে দেশ বা যে সমাজই হোক না কেন, প্রাচীন এ প্রথাই এখনো পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। ফলে বিয়েকে কেন্দ্র করে পাড়াপড়শিদের ঘুম হারাম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
বাংলায় ‘বিয়ে’ শব্দটি এসেছে ‘বিবাহ’ থেকে। এখনো বিয়ের কার্ডে হামেশাই দেখা যায় ‘শুভ বিবাহ’ শব্দযুগল। কথা হচ্ছে, এই ‘বিবাহ’ শব্দের অর্থ কী? এর অনুসন্ধান থেকে কি প্রথার খোঁজ মিলতে পারে? দেখাই যাক। ‘বিবাহ’ শব্দটি গঠিত হয়েছে বি-পূর্বক বহ্ ধাতু ঘঞ্–এর সমন্বয়ে। শব্দটির এই মূলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কাউকে বহন করে আনাকেই বিবাহ বলে। তবে এমন ব্যাখ্যায় বিপদ অনিবার্য। কারণ, মোটাদাগে অর্থটিকে গ্রহণ করলে এমন অনেক কিছুর সঙ্গেই আমাদের ‘বিবাহ’ সম্পাদন হয়ে যেতে পারে, যা আদতে প্রয়োগমূল্য রাখে না।
একইভাবে ‘বধূ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যাকে বহন করে আনা হয়েছে। এখনকার প্রয়োগরীতিতে ‘বধূ’ বলতে যুগলের নারীটিকে বোঝালেও শব্দের অর্থে এর কোনো ছাপ নেই। পুরুষ মানস ও কাঠামো বিয়ে ও বউকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যে এতে নারীকে পুরুষের বাড়িতে আনাকেই স্বতঃসিদ্ধ করে দিয়েছে। তবে এর ব্যতিক্রম কিন্তু আমাদের আশপাশেই আছে। গারো সমাজে এখনো বিয়ে করে বরকে ঘরে তোলা হয়। অর্থাৎ ওই সমাজে এখনো ‘বর’ই ‘বধূ’। একই রীতি প্রচলিত খাসিয়াসহ অন্য মাতৃকেন্দ্রিক ও মাতৃশাসিত সমাজেও। তাই ‘বিবাহ’ শব্দের ব্যাখ্যাটিকে দুজন ব্যক্তির পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়াকে বোঝাটাই সমীচীন।
বিয়ের ইতিহাসও প্রাচীন। ফলে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা রীতি-রেওয়াজ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে প্রধানত মিশে আছে অনুসৃত ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মূলত প্রজাতি রক্ষার তাগিদে অন্য অনেক প্রাণীর মতো মানুষেরও যে শারীরিক সংসর্গের প্রয়োজন হয়, তা-ই সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনে সূত্রবদ্ধ হয়ে আজকের বিয়ে ও পরিবার গঠনের রেওয়াজটি দাঁড়িয়েছে। আর একে শাসন করেছে অঞ্চলভেদে বিরাজমান বিভিন্ন বাস্তবতা। তবে বর্তমান রূপ বা আচার যা-ই হোক না কেন, সৃষ্টির আদিতে প্রজাতি রক্ষার দায়টি না পরিবার, না বিয়ে নামক এ সামাজিক চুক্তির ওপর নির্ভর করত। কারণ, প্রামাণ্যকে বিবেচনায় নিলে মানুষের ইতিহাসে বিয়ে প্রথার প্রচলন হয়েছে কয়েক হাজার বছর হলেও মানুষ প্রজাতিটির বয়স কিন্তু এর চেয়ে ঢের বেশি। যদিও প্রতিটি ধর্মশাস্ত্র ভিন্ন কথাই বলে। যেমন সেমেটিক পুরাণ বলছে, পৃথিবীর প্রথম হত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল সঙ্গী বাছাইকে কেন্দ্র করেই।
যা হোক, মানুষের সমান বয়সী না হলেও বিয়ে প্রাচীন প্রথাই, যা (মুখ্যত) নারী-পুরুষকে একসঙ্গে থাকার ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবার গঠনের সামাজিক স্বীকৃতিটি দেয়। কিন্তু গোল বাধে সমাজের রীতি–রেওয়াজ নিয়ে। ইতিহাস ঘাঁটলে একসময় সামষ্টিক বিয়েকে রীতিসিদ্ধ হিসেবে পাওয়া গেলেও এখন তা সব ‘সভ্য’ সমাজেই অনাচার হিসেবে স্বীকৃত। সামষ্টিক বিয়ে তো দূরের কথা, মাত্রই কদিন আগে বহুগামিতার জন্য কানাডার এক যাজককে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে, যদিও তাঁর অনুসৃত ধর্মরীতিতে এটিই দস্তুর। কিন্তু পৃথিবীর কোনো আইনেই এখন এর স্বীকৃতি নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, সামষ্টিক বিয়ে কী? সামষ্টিক বিয়ে মূলত একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন। মূলত প্রাচীন সমাজে বিদ্যমান অনিশ্চয়তায় মিত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এমন বিয়ের প্রচলন ছিল। এ রীতি অনুযায়ী সামষ্টিক বিয়ের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা সবাই সবার ভাই ও বোন হিসেবে গণ্য হতো। বিপরীতভাবে সবাই সবার মা ও বাবা হিসেবে গণ্য হতো। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘পরিবার ব্যক্তিমালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ বইয়ে এমন অন্তত দুটি উদাহরণ দেওয়া আছে। এ প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ প্রয়োজন হলেও বর্ণনা অবান্তর।
সময়ের সঙ্গে সামষ্টিক বিয়ের ধারা সমাজ থেকে উঠে গেছে। মূলত ব্যক্তি সম্পত্তি ও এর উত্তরাধিকার নির্ধারণের তাগিদ থেকেই উন্নত অর্থনীতির সমাজে এ প্রথা অচল হয়ে পড়ে। এর স্থান দখল করে বহুবিয়ের প্রথা। এটি আবার দুই ধরনের রূপ নেয়। মাতৃকেন্দ্রিক ও মাতৃশাসিত সমাজে বহুপতি এবং পুরুষতান্ত্রিক ও পুরুষশাসিত কাঠামোয় বহুপত্নিক প্রথা। দুটিই প্রচলিত ছিল দীর্ঘদিন।
এক মহাভারতে দুই প্রথার সহাবস্থান দেখা যায়। তাও বেশি ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন পড়ে না। এক পাণ্ডুর পরিবারেই এর দেখা মিলবে। রাজা পাণ্ডুর ছিল দুই স্ত্রী। তাঁদের সন্তান পঞ্চপাণ্ডব আবার বিয়ে করেন এক দ্রৌপদিকে। কিন্তু এই পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে ভীম আবার বিয়ে করে হিরিম্বাকে। আর অর্জুন বিয়ে করে উলুপ, চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রাকে। অর্থাৎ পাণ্ডবদের মধ্যে বহুপতি ও বহুপত্নী ধারার প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব সমাজেও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল এবং আছে। একই প্রথা প্রচলিত ছিল ইউরোপ-আমেরিকাসহ সব অঞ্চলে। আফ্রিকায় এখনো বহুবিয়ে প্রচলিত, দুই অর্থেই। ইতিহাসের পথ ধরে এই প্রথার উদ্ভব হয়েছিল মূলত অঞ্চলভেদে নারী-পুরুষ অনুপাতের ওপর ভিত্তি করে। বহু স্থানে বর্তমান বাস্তবতায় এর লোপ হলেও বর্তমানে প্রধানত পুরুষশাসিত বিশ্বব্যবস্থায় বহু দেশে বহুপত্নিক রেওয়াজ চালু রয়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এ ধরনের পরিবার এখনো দৃশ্যমান। তবে উন্নত সমাজ মাত্রই এ ধরনের প্রথাকে উৎসাহ দেয় না। বহু নয়, বরং একজন নারী ও একজন পুরুষের একসঙ্গে থাকাকেই সমাজ অনুমোদন করে।
সমাজ অনুমোদনের বিষয়টি বরাবরই এসে যায়। কারণ প্রাচীন সমাজের অনিশ্চয়তার বাস্তবতা লুপ্ত হলেও আমরা আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে তার ধারাবাহিকতা বহন করে চলেছি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্থাপনের মৈত্রী স্থাপনে শতসহস্র পন্থা উন্মোচিত হলেও এখনো বিয়ের সামাজিকতাটি হারায়নি। হালে বিষয়টি এক দিনের অনুষ্ঠানে রূপান্তর হলেও পরিজন–পরিবেষ্টিত হয়ে এর উদ্যাপনে কোনো ভাটা পড়েনি।
জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে এখনো অবধারিতভাবেই মানুষকে তার অপরিহার্য যৌথ সত্তাটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আনন্দ, উৎকণ্ঠা ও শোক তাকে এক কাতারে নিয়ে আসে। সদম্ভে ঘোষণা করে, মানুষ মূলত সামাজিক জীব। আর এই সমাজই হচ্ছে মানুষের আজকের সব অর্জনের পেছনের মূল কারণ। তাই একসময় গোত্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির কারণে সমষ্টি বিয়ে থেকে যাত্রা করে এখন একক বিয়ের পর্যায়ে মানুষ উন্নীত হলেও সমাজ চেতনাটি তার রয়ে গেছে। আর ঠিক এ কারণেই বিয়ে নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এখনো আক্ষরিক অর্থেই ঘুম হারাম হয়ে যায় পাড়া পড়শিদের। আর যখন প্রসঙ্গটি বাংলাদেশ কিংবা আরও বড় করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশের, তখন এ প্রবাদ জাজ্বল্যমান সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, এখনো এই অঞ্চলে পারিবারিক সম্বন্ধই দস্তুর। বিয়ে এখনো এখানে দুজন ব্যক্তি নয়, বরং দুটি পরিবার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুটি এলাকার মধ্যে হয়ে থাকে। ফলে পশ্চিমের তুলনায় এ অঞ্চলের বিয়ে এখনো অনেক বেশি মাত্রায় গোত্রমুখী ধারণায় আবদ্ধ, যা এমনকি মাঝেমধ্যে ব্যক্তিকেও রুদ্ধ করে।