কীটনাশক প্রয়োগে মাছ শিকার

Slider খুলনা

610a7399007bf6668daa44fab7a91f61-5a35d10edae25

 

 

 

 

সুন্দরবনে কীটনাশক ব্যবহার করে মাছ শিকার করা হচ্ছে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা ও নলিয়ান রেঞ্জে কীটনাশকের ব্যবহার বেশি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য সুন্দরবনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কীটনাশক ব্যবহার করায় শুধু সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে না। এই বিষাক্ত পানি পান করে বাঘ, হরিণ, বানরসহ সব বন্য প্রাণী হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলো বিষাক্ত হয়ে পড়ছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে অনেক দিন ধরে এভাবে মাছ ধরা হচ্ছে। তবে চাঁদপাই রেঞ্জে জেলেদের অপতৎপরতা তুলনামূলক বেশি। এ রেঞ্জের জোংড়া, ঢাংমারী, মৃগমারী, বৈদ্যমারী, জয়মনী, কাটাখালী, জিউধরা, নন্দবালা, ঘাগরামারী, হারবাড়িয়া, শুয়ারমারা, হরিণটানা, নলবুনিয়া, আন্ধার মানিক, মরা পশুর, ঝাঁপসি ও লাউডোব এবং নলিয়ান রেঞ্জের কালাবগী, ঝনঝনিয়া, হলদিখালী, টেংরামারী, ভদ্রা, কোরামারীসহ বনের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন খাল ও নদী এলাকায় অবাধে কীটনাশক প্রয়োগ করে মাছ ধরা হচ্ছে।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া, ঢাংমারী, মৃগমারী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কয়েক জায়গায় কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এসব জেলের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

তবে ওই এলাকায় স্বাভাবিকভাবে মাছ ধরছে এমন জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কম পরিশ্রমে বেশি মুনাফা লাভের আশায় জেলে নামধারী দুর্বৃত্তরা এ কাজ করছেন। তাঁরা বনে প্রবেশের সময় তাঁদের নৌকায় লুকিয়ে কীটনাশক নিয়ে আসেন। পরে জোয়ার হওয়ার কিছু আগে ওই কীটনাশকের সঙ্গে চিড়া, ভাত মিশিয়ে নদী ও খালের পানির মধ্যে ছিটিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই এলাকায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কীটনাশকের তীব্রতায় নিস্তেজ হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। এসব মাছ প্রথমে স্থানীয় আড়তে আনা হয়। পরে তা স্থানীয় বিভিন্ন বাজারসহ খুলনা, ঢাকা, ফেনী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন শহরে বাসযোগে সরবরাহ করা হয়।

মোংলা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মাছ শিকার করতে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ধান ও বিভিন্ন শাকসবজির খেতে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ মারার কাজে ব্যবহার করা হয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, এ জাতীয় কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানের ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। এই দুষ্কৃতকারীরা সেখান থেকে শুধু বড় মাছগুলো সংগ্রহ করে। ছোট মাছগুলো তারা নেয় না। কিন্তু এই ছোট মাছগুলো ছিল বড় মাছের খাবার। ফলে ওই এলাকার খাদ্যচক্রেও প্রভাব পড়ছে। আবার এই কীটনাশক মিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, তখন সেই এলাকার মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব কীটনাশক এখানে প্রয়োগ করা হয়, তার বিষক্রিয়া-সংশ্লিষ্ট এলাকায় চার মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত থাকে।

বন বিভাগের খুলনা সার্কেল অফিস সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরার অপরাধে ৪০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের জুন, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরার সময় জেলেদের আটক করে কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ।

তবে স্থানীয় একাধিক জেলে ও বনজীবীর অভিযোগ, মাঝে মাঝে কিছু দরিদ্র জেলেকে পুলিশ ও বন বিভাগ আটক করে। কিন্তু এর পেছনে মূল হোতা ও আড়তদারেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। গত নভেম্বর মাসে চাঁদপাই রেঞ্জের এক কর্মকর্তা ও তিন প্রহরীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে কীটনাশক ব্যবহার করে মাছ শিকার করছিলেন এমন জেলেদের ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, মাছ বিষ অথবা কীটনাশক দিয়ে ধরল কি না, তা পরীক্ষা করার কোনো পরীক্ষাগার বন বিভাগের নেই। ফলে অনেক সময় আদালতে প্রমাণের অভাবে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এ জন্য সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। আর বনকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব জেলেকে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউল ইসলাম বলেন, হাতেনাতে কাউকে আটক করতে পারলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া যায়। তবে সব সময় তা সম্ভব হয় না। সে জন্য বন বিভাগের সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষাগার স্থাপন করা এবং বন আইনকে আরও যুগোপযোগী করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *