আজ মহান বিজয় দিবস। কাঙ্ক্ষিত এ দিনটির জন্য বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক কাল, পেরোতে হয়েছে পরাধীনতার দীর্ঘ অর্গল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর আজকের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে আঁকা হয়েছে গৌরবের অমলিন এক তিলক।
সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় পাঁচ দশক হতে চলেছে। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে এ খুব দীর্ঘ সময় নয়। ব্যক্তির ইতিহাস আর রাষ্ট্রের ইতিহাস পাশাপাশি এক রেখায় চলে না। রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী। একটি রাষ্ট্রের পেছনে হাজার বছরের ইতিহাস থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যে নির্দিষ্ট অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলছি, তা তো মাত্র ৪৬ বছর আগের অর্জন।
ব্যক্তির জীবনে এই সময়টুকু প্রৌঢ়ত্বকালের আরম্ভ। আর রাষ্ট্রের হিসাবে তা নেহাতই শৈশবকাল। সেই অজুহাতে তাই বলে বাংলাদেশকে ‘শিশুরাষ্ট্র’ বলে তার সার্থকতা বা অসাফল্যের দিকটি অগ্রাহ্য করা চলে না। ব্যক্তির হিসাবে রাষ্ট্র যা দিতে পারে, ব্যক্তি শুধু সেই হিসাবটুকুই করে। অতীত বা ভবিষ্যৎ গুরুত্ব তার দৈনন্দিন জীবনে সাধারণত তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না।
আমি খানিকটা দীর্ঘজীবী হয়েছি বলে এক অর্থে আমাকে ত্রিকালদর্শী বলা যায়। ব্রিটিশ উপনিবেশের ভারতবর্ষে কেটে গেছে আমার পুরো শৈশব। তারুণ্যের শুরুতে হয়েছে পটপরিবর্তন, পাকিস্তান নামে নতুন একটি রাষ্ট্র হয়েছে। যার একটি অংশ আরেক অংশ থেকে ১২শ মাইল দূরে অবস্থিত। দুই অংশের নামও হয়েছে আলাদা আলাদা—পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিকভাবে গঠিত এই রাষ্ট্র বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাস্তবতা হলো, এককালের পশ্চিম পাকিস্তান এখন নিজেকে পুরো পাকিস্তান বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধের মতো জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যেখানে আমাদের নিজের মতো করে পথচলার সূচনা।
বিজয়ের এই মুহূর্তে পেছন ফিরে নিরাসক্তভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, গাঙ্গেয় বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন নেহাত কম নয়। নানা দিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। বাংলাদেশের বিশাল কর্মযজ্ঞের নানা দিকের স্বীকৃতিও বিশ্বের মানুষ দিচ্ছে। কিন্তু কথা তারপরও থাকে। সাধারণ মানুষ বলতেই পারে, অন্যের মুখে ঝাল খেলে কী তার স্বাদ, সেটি কখনোই বোঝা যায় না। নিশ্চয় আমরা এ কথাও বলব, সাধারণ মানুষ, যাদের বলা হয় আমজনতা, তারা এসব উন্নয়ন চাক্ষুষ করেছে বটে, তবে তা সরাসরি তাদের জীবনের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে যে যুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে, এমনটি বলা যাবে না। এসব কারণেই বঙ্গীয় লোককথায় বলা হয়, ‘যত গর্জে, তত বর্ষে না।’
সমাজের ওপরতলার মানুষ বলবে, কোথাও কোনো দুর্যোগ নেই। কিন্তু দেশের ১৭ কোটি মানুষের ৯০ ভাগই এ কথা বলবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের সমগ্র সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহার এখনো অল্পসংখ্যক মানুষেরই করতলগত। দারিদ্র্য নেই অথবা দুমুঠো ভাতের অভাব নেই, এ কথায় শাসকদের আত্মবিশ্বাস বাড়তে পারে, তাঁরা প্রশান্তিও লাভ করতে পারেন, তবে বিষমবৈষম্যের তাতে কোনো হেরফের হয় না। আবার দুমুঠো ভাতই তো মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে আমাদের এই সমাজে বিত্ত ও সম্পদের বৈষম্যের কারণে বিস্তর ব্যবধান আজও রয়েছে। তাই মাথাপিছু রোজগার বেড়েছে বললে আদতে তেমন কিছু বোঝা যায় না। গড় আয় যদি ১০ ভাগ হয়ে থাকে, জনগণ তার দুই ভাগের বেশি মালিক হতে পারে কি? পারে না। শেষ অব্দি বাকি আট ভাগ মুষ্টিমেয়র হাতেই থাকে, থাকছে। মূলত এ জন্যই দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্জনে অধিকাংশ মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও সেটি ভোগ করছে কেবল উঁচু শ্রেণির মানুষ। এদিক থেকে হিসাব করলে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের গলাবাজি করতে আমাদের একটু লজ্জা হওয়ারই কথা। আমার এই কথাগুলো যে মনগড়া নয়, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাবে।
তবে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি রাষ্ট্র অর্জন এ দেশের মানুষের গৌরবকে যে হিমালয়তুল্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, সেটিও অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের প্রথম সংবিধান পৃথিবীর যেকোনো উন্নত রাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে। কিন্তু গত সাড়ে চার দশকে এই সংবিধানের বহু কাটাছেঁড়া হয়েছে। এখন পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এ দেশের সংবিধানে থাকলেও বাস্তবে তা কতটা কার্যকর, সেটি প্রশ্নের বিষয়। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মূল স্তম্ভগুলোর অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা, তথা অসাম্প্রদায়িকতা বর্তমান সময়েও বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর এ তো জানা কথা যে ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হলে গণতন্ত্রও টিকতে পারে না। জনগণের পক্ষ থেকে বাস্তবে যাঁরা এই রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বলেই যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা নিশ্চয় জানেন, সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা সরকারসহ সাধারণ মানুষের জন্য রীতিমতো আতঙ্কজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একটি হলো উগ্রপন্থী মনোভাবের উত্থান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য এদের সমূলে উচ্ছেদ করতেই হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করতেই হবে।
ভুললে চলবে না, এই বাংলাদেশ বহু মানুষের রক্তে কেনা। কেবল মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে এ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। তা-ও সমগ্র পৃথিবীর সামনে এক অনন্যসাধারণ অর্জন। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায়, প্রকৃতপক্ষে আমরাই তার মালিক। পলিমাটিময় এই দেশের মাটি অকল্পনীয়ভাবে উর্বর। এ দেশের প্রকৃতি স্নিগ্ধ, নয়নাভিরাম। মানবসম্পদও আমাদের বড় সম্পদ। সব মিলিয়ে শত সম্পদে ভরা বাংলাদেশ বিপুল বৈচিত্র্যে সাজানো। তাই কবির কথাটি মানতেই হয়, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’। তবে ইতিহাসের নিরিখে বিশেষ করে এই কথাটিও বলতে হবে, বাংলাদেশ নামের এই বসুন্ধরায় জনগণমুখী শাসন ছাড়া কোনো রকম রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্য মানুষ মেনে নেয়নি, কখনো নেবেও না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও বিজয়ের ক্ষণটি আমার পক্ষে কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই ক্ষণ আমি দেখেছি এবং তাতে অংশ নিয়েছি। সোনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আমার অস্তিত্বের অন্তস্তলে তা গেঁথে আছে।
হাসান আজিজুল হক: কথাসাহিত্যিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।