মহানগরের নেতারা জানিয়েছেন, এত দিন এই দ্বন্দ্ব দলীয় ফোরাম ও কথার মারপ্যাঁচে সীমাবদ্ধ ছিল। এর কিছুটা প্রকাশ ঘটে গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদের সময়। লম্বা বিরতি দিয়ে আবার তা দেখা যায় মগবাজার উড়ালসড়ক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। আর দ্বন্দ্বের সহিংস প্রকাশ ঘটে গত বৃহস্পতিবার আজিমপুরে পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারের সভাস্থলের সামনে ময়লা ফেলা এবং দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও মোটরসাইকেল পোড়ানোর মধ্য দিয়ে।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের সমর্থকেরা মুরাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও তুলেছেন। তাঁদের দাবি, গুলিস্তানের আশপাশের ৯টি মার্কেটের পার্কিংয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অবৈধ দোকান থেকে মুরাদের নামে মাসে কয়েক কোটি টাকা তোলা হয়। তাঁর কারণে পার্কিংমুক্ত করা যাচ্ছে না। গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকেও তাঁর নামে চাঁদা তোলা হয়। এ ছাড়া গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিলে হকার তুললেই মুরাদের লোকজন আবার তাদের বসিয়ে দিচ্ছে, চাঁদা তুলছে। হকার তোলা নিয়ে মেয়র ও মুরাদের পক্ষের লোকজনের মধ্যে গুলিস্তানে গোলাগুলিও হয়েছিল। এসব নিয়ে মেয়র ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে মুরাদের বিরোধ তৈরি হয়েছে।
সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি গঠনে মুরাদের একচেটিয়া প্রভাব দেখা যাচ্ছে। প্রস্তাবিত কমিটিতে বরিশালের লোকজনই বেশি রাখা হয়েছে। অথচ নির্বাচনের সময় তাঁরা নিজ এলাকায় চলে যাবেন।’ তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ঢাকাইয়াসহ ৬৪টি জেলার লোক বাস করে। কিন্তু মহানগর কমিটিতে যদি আঞ্চলিকতার প্রভাব পড়ে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনের সময় দলকে খেসারত দিতে হবে। ঢাকার নির্বাচনে মাঠে নেতা পাওয়া যাবে না। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়কে ভাবতে হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, গত বছরের এপ্রিলে আবুল হাসনাতকে সভাপতি ও শাহে আলম মুরাদকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু শাহে আলম মুরাদ দলে ভদ্র লোক হিসেবে পরিচিত আবুল হাসনাতকে পাত্তা দেন না। একাই সব কিছু করেন। মুরাদ দলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের লোক হিসেবে পরিচিত। পার্ল হারবারের সভায়ও খাদ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২৩টি থানা, ৫৭টি ওয়ার্ড কমিটিতে নিজেদের লোক ঢোকানো নিয়ে এখন সবাই মুখ খুলছে। এসব কমিটি গঠন নিয়ে মুরাদের বিরুদ্ধে দলীয় ফোরামে অভিযোগও করেছেন কাউন্সিলররা।
এর মধ্যে উড়ালসড়ক উদ্বোধনের সময় ডিএসসিসির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও দলের মহানগর দক্ষিণের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীকেও মুরাদের লোকজন লাঞ্ছিত করেন। মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী মহানগর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা। তিনি বৃহত্তর সূত্রাপুর থানার এক টানা ২৫ বছর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর যে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদকে রক্ষা করতে গিয়ে আবু আহমেদ মন্নাফী লাঞ্ছিত হয়েছেন, তিনিও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য। এর আগে তিনি তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর কমিটির সহসভাপতি ছিলেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
১ নভেম্বর দলের বর্ধিত সভায় এ ঘটনার বিচার চেয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
আবু আহমেদ মন্নাফী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করেছে মুরাদের লোকজন। তার প্রতিবাদেই আজিমপুরে নাগরিক কমিটি কর্মসূচি দেয়। অথচ মুরাদের কর্মীরা আমাদের সেখানে দাঁড়াতে দেয়নি। এসব ঘটনার জন্য মহানগরের নেতাদের পক্ষ থেকে মুরাদের পদত্যাগ দাবি করছি। এই পদে থাকার যোগ্যতা তার নেই।’
পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারটি ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ওয়ার্ড থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটির একটি তালিকা মুরাদের কাছে দিয়েছি। কিন্তু তিনি আমাদের কারও নাম প্রস্তাবিত তালিকায় রাখেননি।’
মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত বলেন, ‘মূলত এই কমিটি গঠন নিয়েই মেয়র বা কাউন্সিলদের সঙ্গে মুরাদের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের সমাধান মুরাদকেই করতে হবে। তার দায় আমি নেব না।’ তিনি বলেন, ‘মুরাদ আমাকেও সেভাবে মূল্যায়ন করে না। আমার স্বাক্ষর বা অনুমতি ছাড়াই সে অনেককে নেতা বানিয়েছে। এ ছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও আমাকে জানায় না। তার যখন যা মন চায়, তা-ই করে।’
সব অভিযোগ অস্বীকার করেন শাহে আলম মুরাদ। তিনি বলেন, কমিটি নিয়ে মেয়র বা কাউন্সিলর—কারও সঙ্গেই তাঁর দ্বন্দ্ব নেই। নিয়ম অনুযায়ীই কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
আটকেরা ছাড়া পেয়েছেন
লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পার্ল হারবারের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যে ছয়-সাতজনকে থানায় নেওয়া হয়েছিল, তাদের রাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার রাত ১১টা পর্যন্ত ওই ঘটনায় কেউ মামলাও করেনি।