পুলিশের এবার ৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প!

Slider ঢাকা

e728cc19e84e3e1a78af6a3f50e4a9ec-5a0d6e3c80098

 

 

 

 

ঢাকার জনগণকে নিরাপত্তা দিতে গত ১০ বছরে পুলিশের নেওয়া তিন প্রকল্পের ১০০ কোটি টাকা পানিতে গেছে। আর এবার নেওয়া হচ্ছে সাত হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রকল্প। এর আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বসানো হবে ১৬ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা। অথচ আগের একটি প্রকল্পের ১৫৫টি ক্যামেরা কোনো কাজেই লাগানো হয়নি।

‘ডেভেলপমেন্ট অব ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম’ নামের এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এটা এখন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে বড় প্রকল্প। নতুন এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় পুলিশের এক বছরের বাজেটের অর্ধেকের বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে পুলিশ বাহিনীর মোট বাজেট ১২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। ৮ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত যাচাই-বাচাই কমিটির বৈঠকে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হয়। প্রকল্প প্রস্তাব এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

 প্রস্তাবিত প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) গাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা আছে, তা আর থাকবে না।

আগে তিনটি প্রকল্পের টাকা কী করে পানিতে গেল, তা নিয়ে পুলিশের একেক কর্মকর্তা একেক ধরনের কথা বলেন। তবে সবারই অভিমত, যাচাই-বাছাই না করে প্রকল্প হাতে নেওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে। তিনটি প্রকল্পের এমন হাল হওয়ার পর আবার নতুন প্রকল্প কেন নিচ্ছেন—প্রশ্ন করা হলে গাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আগের ক্যামেরা প্রকল্পটি এখন আর রাজধানীতে কোনো কাজে আসবে না। প্রকল্পটি ছিল ছোট আকারের। এ প্রকল্প অন্য কোনো জেলায় স্থানান্তর করা হতে পারে। অন্য দুটি প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।

জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মুহা. নূরুল হুদা বলেন, এ ধরনের বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে কোন দেশ এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেটা ভালো করে দেখতে হবে। তার চেয়ে বেশি দরকার এর ভবিষ্যৎ কী হয়, সেটা মাথায় রাখা। আর প্রকল্প নেওয়ার আগে ভালো করে স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সমীক্ষা চালাতে হবে। জনগণের কষ্টের অর্থ যেন কারও খেয়ালখুশিতে পানিতে না যায়, সেদিক নজর দিতে হবে।

 

কী আছে নতুন প্রকল্পে

প্রকল্পের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, ২০১৫ সালে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা শুরু করে পুলিশ প্রশাসন। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এরপর আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়। দরপত্রে ১৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও চীনের হুয়াজিন নামের এক প্রতিষ্ঠান যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি এক বছর জরিপ করার পর যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তার আলোকেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়।

১৫৫ সিসি টিভি ক্যামেরা সচল রাখা যায়নি, এখন বসানো হবে ১৬ হাজার

এতে দেখা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন মোড় ও সড়কে মোট ১৬ হাজার ক্যামেরা বসানো হবে। ক্যামেরাগুলো পর্যবেক্ষণ বা মনিটর করা হবে আবদুল গণি রোডের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে। আবদুল গণি রোডের এই নিয়ন্ত্রণকক্ষকে ৪ তলা থেকে ১৫ তলায় রূপান্তর করা হবে। প্রধান নিয়ন্ত্রণকক্ষ ছাড়াও রাজধানীর ৪৯টি থানাসহ ৭০টি স্থানে ছোট আকারের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকবে। এসব নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে স্থাপন করা সব ক্যামেরার দৃশ্য দেখা যাবে। এই ক্যামেরা মানুষ ও বস্তুর চেহারা শনাক্ত করতে পারবে। ক্যামেরা দিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও গাড়ির ভুয়া নম্বরপ্লেটও শনাক্ত করা যাবে।

যোগাযোগের জন্য থাকবে ফোর-জি মডেলের ওয়াকিটকি। এই ওয়াকিটকি থেকে একসঙ্গে অনেক মানুষ যোগাযোগ করতে পারবেন। এতে অডিও-ভিডিও তথ্য আদান-প্রদান করা যাবে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে গুলি শনাক্ত করার যন্ত্র বসানো থাকবে। কোথাও গুলি হলে সঙ্গে সঙ্গে তা বের করে দিতে পারবে এই যন্ত্র। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গুলির উৎসস্থল শনাক্ত করে দিতে পারবে। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে থাকবে এলইডি বোর্ড। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে এই বোর্ডের মাধ্যমে যানবাহন-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া যাবে।

সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে দেড় হাজার জনবল লাগবে, এর মধ্যে ১০৭ জন থাকবেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। পুরো প্রকল্পটি হবে প্রায় তিন শ বর্গকিলোমিটারজুড়ে। রাজধানীর প্রায় দুই কোটি মানুষ এর আওতায় আসবে। এ ব্যয় সংকুলান হবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাজেট থেকে।

 

পরিত্যক্ত ক্যামেরা প্রকল্প

পুলিশের কাজকে সহজতর ও গতিশীল করতে ১৯৯৮ সালে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন কন্ট্রোল রুম আধুনিকায়ন’ নামে একটি প্রকল্প পরিকল্পনা শুরু হয়। তবে এর বাস্তবায়ন শুরু হয় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ১৫৫টি সিসি ক্যামেরা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ৩১টি ট্রাফিক ডিসপ্লে বোর্ড লাগানো হয়। আবদুল গণি রোডে স্থাপন করা হয় (কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন) নিয়ন্ত্রণকক্ষ। এরপর ওই প্রকল্প থেকেই পুলিশকে দেওয়া হয় ১ হাজার ২৩টি আধুনিক টেট্রা সিস্টেম-সংবলিত (টেরিস্ট্রিয়াল ট্রাংকড রেডিও) ওয়াকিটকি বা বেতারযন্ত্র, থানার ৩০টি টহল গাড়িতে স্থাপিত হয় স্বয়ংক্রিয় যান শনাক্তকরণ ব্যবস্থা। পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় দেড় বছর এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে পুলিশ। এরপর সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল ফলেক কমিউনিকেশনস নামের ব্রুনেইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। পুলিশ প্রকল্প বুঝে না নেওয়ার কারণে তারা ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়।

মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। পুলিশ কখনো প্রকল্পটি বুঝে নেয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্প বিএনপির আমলে নেওয়া হয়েছিল, তাই এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভীতি ছিল। ভবিষ্যতে কোনো আইনি ঝামেলা হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁরা প্রকল্পটি বুঝে নেননি।

 জানতে চাইলে পুলিশ টেলিকমের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) বিনয় কৃষ্ণ বালা প্রথম আলোকে বলেন, এসব প্রকল্প অনেক পুরোনো, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।

 

আরও দুই প্রকল্পের একই হাল

ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নিজস্ব মাইক্রোওয়েবের মাধ্যমে কম্পিউটার যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল পুলিশ টেলিকম। ২০০৭ সালে নেওয়া সেই প্রকল্প এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। ইতিমধ্যে প্রকল্পের তিন ঠিকাদার ৭০ শতাংশ অর্থ তুলে নিয়ে চলে গেছেন।

২০ কোটি টাকার প্রকল্পে অর্থ জুগিয়েছিল জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। পরিকল্পনা ছিল, মাইক্রোওয়েব সংযোগ ব্যবহার করে পুলিশ নিজেদের কম্পিউটার যোগাযোগ স্থাপন করবে। এ জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল মাইক্রোওয়েব বসানো, একটির কাজ কম্পিউটার স্থাপন করা এবং আরেকটির কাজ ছিল মাইক্রোওয়েব ও কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা (পয়েন্ট টু পয়েন্ট লিংক)। কিন্তু মাইক্রোওয়েব স্থাপনের পর দেখা গেল, কম্পিউটারের বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ফলে সংযোগ আর হয়নি।

২৮ কোটি টাকার অন্য প্রকল্পটি ছিল সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। চার মহানগর বাদে সারা দেশে ডিজিটাল বেতার (টেট্রা রেডিও) যোগাযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা ছিল পুলিশের। এ জন্য রাজারবাগ, সাভার, খুলনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ছয়টি বেজ স্টেশন স্থাপন করা হয়। কাজটি পেয়েছিল সিঙ্গাপুর টেলিকম (এসটি)। কিন্তু বেজ স্টেশন স্থাপনের পর দেখা গেল, কোনো কাজই হচ্ছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ জন্য আরও বেজ স্টেশন স্থাপনের পরামর্শ দেয়, কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় প্রকল্পটি পড়ে থাকে। এ অবস্থায় ২০১২ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর টেলিকম ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। এভাবে পানিতে পড়ে যায় প্রকল্পের টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নগর-পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করার আগে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এর পেছনের মানুষগুলো ঠিক আছে কি না, সেটা দেখা। যেমন ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল–ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক ব্যবস্থা। কিন্তু পুরো নগর অব্যবস্থাপনার কারণে এটি কাজই করছে না। সিসি ক্যামেরা দিয়ে শহর ভরিয়ে দিলেও এর পেছনের লোকেরা যদি সৎ এবং দক্ষ না হন, তাহলে হাজার হাজার ক্যামেরা বসিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং দেখা যাবে, এসব ক্যামেরাকে কাজে লাগিয়ে নতুন ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *