মানুষের জীবনের চেয়ে মোবাইল ফোন খুব দামি! হ্যাঁ, আমি জোর দিয়ে আবারও বলছি, মোবাইল ফোন অবশ্যই মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক দামি। জীবনের চেয়ে মোবাইল ফোন দামি না হলে কি আর আগুনে পুড়ে মরতে হয় আজিজাকে?
গতকাল শনিবার অনলাইনের খবর, নরসিংদীর শিবপুর থানার খৈনকুর গ্রামের ১৫ বছরের কিশোরী আজিজা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছে। এক প্রতিবেশী তার বিরুদ্ধে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে গত শুক্রবার রাতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন! আগুনে ৯৬ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল আজিজার শরীর। আর কি বেঁচে থাকা সম্ভব তার পক্ষে?
রাজনকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই মানুষরূপী কতগুলো পশু রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এর এক বছর পর গত বছরের জুলাই মাসে হবিগঞ্জ শহরের গরুর বাজার এলাকায় মোবাইল ফোন চুরির অপরাধে তিন শিশুকে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তাদের ভাগ্য ভালো, সময়মতো পুলিশ এসে পড়ায় তারা উদ্ধার পায়। গত বছরের নভেম্বর মাসে রাজধানীর ভাসানটেক থানা এলাকায় মোবাইল ও টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে শুভ (১৭) নামের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত বছরই শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা সদরে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে ফিরোজ সরদার (২০) নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এরপরও কি কারও মনে সন্দেহ আছে যে মোবাইল ফোন জীবনের চেয়ে দামি নয়?
গত বৃহস্পতিবার আমার এক ফেসবুক বন্ধু মেসেঞ্জারে আমাকে একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠান। সেই ভিডিওতে ছিল এক ভারতীয় নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য। ভারতের মধ্যপ্রদেশের ওই নারীর অপরাধ ছিল তিনি হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও খ্রিষ্টানদের গির্জায় গিয়ে এক প্রার্থনাসভায় অংশ নিয়েছিলেন। এটা মানতে পারেনি তাঁর গ্রামের লোকজন। তাই তারা তাঁকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে। এই ভিডিও ক্লিপটি দেখার পর আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারিনি। এটা কোনো অপরাধ হতে পারে? তখন আমি এটা ভাবলাম যে ভারতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব। আমাদের দেশে সামান্য অপরাধে এভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে না। দুদিন না যেতেই আমার এ ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো।
একটা মোবাইল ফোনের কত দাম? বা আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের লোকজন কত টাকা দামের মোবাইল ফোন কেনেন? দুই হাজার, তিন হাজার, পাঁচ হাজার, সাত হাজার, বিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ? জানতে ইচ্ছে করে, কত টাকা দিয়ে আজিজার ওই প্রতিবেশী তাঁর চুরি হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটি কিনেছিলেন? তার দাম কি একটি জীবনের চেয়েও বেশি? যদি সত্যিই আজিজা মোবাইল ফোনটি চুরি করত, তাহলে তা উদ্ধারের তো আরও অনেক পথ খোলা ছিল। ওই প্রতিবেশী কি পারতেন না থানায় মামলা করতে বা আজিজাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে? এত ঝামেলা কে করে? এর চেয়ে মেরে ফেলাই তো সহজ। তাই না?
আসলে আমাদের দেশে সবকিছুরই মূল্য আছে। শুধু মানুষের প্রাণের কোনো মূল্য নেই। তুচ্ছ কারণে একে অপরের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অথচ জীবনের দাম ক্রমাগত কমেই চলেছে। যে জীবন আমি কাউকে দিতে পারি না, সে জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার তো আমার নেই। কিন্তু নিষ্ঠুর প্রজাতির এসব মানুষ তা কখন বুঝবে? আসলে কখনোই মনে হয় বুঝবে না। ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো হত্যাকাণ্ড। কিন্তু দেশে এত হত্যাকাণ্ড হয়ে চলেছে। কয়টার বিচার আমরা হতে দেখি। বিচার হলেও সেসব বিচার কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করে না। ফলে কেউ আর কাউকে হত্যা করতে ভয় পাচ্ছে না। আজিজাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, দিতে হবে, দিতে হবে। তা না হলে আরও অনেক আজিজা আর রাজনের মৃত্যু আমাদের দেখতে হবে।