বিএনপির অন্যতম প্রধান ছয় প্রস্তাবের ঠিক বিপরীতমুখী অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি এই ছয় বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে যে প্রস্তাব তুলে ধরবে, তা বিএনপির প্রস্তাবের একেবারেই উল্টো।
গত রোববার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি ২০ দফা প্রস্তাব দেয়। সেখানে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ভোটের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় নির্বাচন, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে মোতায়েন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করা এবং সরকারের সঙ্গে বিএনপি ও অন্যান্য দলের সংলাপ অনুষ্ঠানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপির ২০ দফায় মোট ৬৩টি প্রস্তাব রাখা হয়। এগুলোর মধ্যে নির্বাচনী আইন (আরপিও), নির্বাচনী আচরণবিধি, দল নিবন্ধন বিধি, পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালার সংশোধনী প্রস্তাবই বেশি।
সংলাপে বিএনপির প্রতিনিধিদলের সদস্য ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির প্রস্তাব একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। সাধারণ মানুষও এটা চায়। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। সব সময় সব ক্ষমতা সংবিধান বা আইনে থাকে না। প্রয়োজনে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। কমিশন যদি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটা জরুরি, তাহলে অবশ্যই সরকারকে এটা বলতে হবে। এর মাধ্যমে কমিশনের আন্তরিকতা প্রকাশ পাবে। ফলে সব দল তাদের প্রতি আস্থাশীল হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাল বুধবার সকালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসবে। সেখানে দলের পক্ষ থেকে মোট ১১ দফা প্রস্তাব তুলে ধরা হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যা বলা হবে, তা বিএনপির এই ছয় প্রস্তাবের বিপরীত বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য। তিনি বলেন, দলের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবে বলা হবে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ভূমিকায় থাকবে। এই সরকারের প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোটের সময় সংসদ বলবৎ থাকবে। তবে শেষ তিন মাসে সংসদের কোনো অধিবেশন বসবে না।
বর্তমান সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন প্রয়োজন নেই বলে আওয়ামী লীগ তাদের প্রস্তাবে উল্লেখ করবে। আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে এবং কমিশন একান্ত প্রয়োজন মনে করলে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। ই-ভোটিং করতে পারলে ভালো হবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করবে কমিশনে। তবে আগামী নির্বাচনের আগে তিন লাখের বেশি ইভিএম যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব না হলে ‘টোকেন’ হিসেবে কিছু আসনে তা করার প্রস্তাব দেবে দলটি। আর সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় না আনা এবং এই বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার বিএনপির প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে আওয়ামী লীগ। দলটি সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করার সুপারিশ করবে।
আর ‘রাজনৈতিক সংকট’ নিরসনে সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বৈঠকের বিষয়টি এখনই গুরুত্ব দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনেরা। কমিশনের প্রস্তাবে এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও কমিশনের এ–সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত হবে না বলে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কমিশনকে সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতার মধ্য থেকে কাজ করার কথা বলবে আওয়ামী লীগ। কমিশনের এখতিয়ারে নেই, এমন কাজের দায়িত্ব নেওয়া সম্পর্কেও আওয়ামী লীগ তাদের ‘সতর্ক’ করবে। দলটি বলছে, কিছু বিষয়ে আওয়ামী লীগ লিখিত বক্তব্য দেবে না। নির্বাচন কমিশনের সবাই দায়িত্বশীল। তাঁরা কিছু বিষয় আওয়ামী লীগের বক্তব্য থেকে ধারণা নেবেন—এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির ২০ দফা প্রস্তাবের মধ্যে এখনই সব রাজনৈতিক দলকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেওয়া, ব্যালট পেপারের নিরাপত্তায় সেখানে কমিশনের লোগোর জলছাপ দেওয়া, নির্বাচনী আইন ও বিধি–বিধানের সংস্কার, ভোটের এক বছর আগে কোনো দলকে নিবন্ধন না দেওয়া, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রশাসনের ‘দলকানা’দের ভোটে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মতো বিষয়গুলোতে আওয়ামী লীগের সমর্থন রয়েছে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এটা একটা মীসাংসিত বিষয়। কেননা ২০১৪ সালে বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হয়েছে। বিএনপির দাবি, ওই নির্বাচন মানুষ গ্রহণ করেনি। তাহলে এখন আবার এই দাবি কেন তোলা হচ্ছে। সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের মূলে থাকবে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন ও এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন শেখ হাসিনা। এটা মেনে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। এরপর যদি কোনো দাবি থাকে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
দলটির আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বললেন, বিএনপির দাবি মানতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে সেই সম্ভাবনা নেই। আর এখন বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন নেই। নির্বাচনের আগে দেখা যাবে।
সংলাপে আওয়ামী লীগ আরপিও সংশোধনে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবে। দলের প্রস্তাবে ভোটের দিন পর্যবেক্ষকদের আচরণ, সব প্রার্থীর জন্য একক সভাস্থল নির্ধারণ, একক পোস্টার চালু করাসহ কয়েকটি বিষয় থাকতে পারে। নির্বাচনে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের একটা অংশ নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে ভিড় তৈরি করে। ফলে ভোট গ্রহণে সমস্যা হয়। আবার কিছু কেন্দ্রে পর্যবেক্ষকেরা যান না। তাই নির্বাচন কমিশন যাতে পর্যবেক্ষকদের সব কেন্দ্রে অবস্থান নিশ্চিত করে, এমন প্রস্তাব দিতে পারে আওয়ামী লীগ।
সূত্র; প্রথম আলো