তদন্তের দুর্গতি, আদালতই ভরসা শারমিনের মায়ের

Slider নারী ও শিশু

5675913ab7729ac7f4596e1eb3ff4c7d-59e56c4692e0c

 

 

 

 

 

 

 

গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শারমিন সরকার যখন লাইফ সাপোর্টে, তখন থেকে মা সুফিয়া সরকারের যুদ্ধ শুরু। ‘চিকিৎসকদের অবহেলায়’ মেয়ের মৃত্যুর দুই বছর পরও ন্যায়বিচার পেতে যুদ্ধ করছেন তিনি। থানার পুলিশ, ডিবি ও পিবিআইয়ের কাছ থেকে অসহযোগিতার পর আদালত এখন তাঁর শেষ ভরসা।
সুফিয়া সরকার বলেন, ‘আমি বারবার অনুরোধ করেছিলাম তদন্তটা যেন ঠিকমতো হয়। তদন্ত না করেই ডিবি, পিবিআই ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিল।’
গলার চামড়ার নিচে টিউমার নিয়ে শারমিন সরকার (১৭) উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান ফিরোজ আহম্মেদ খানের অধীনে ভর্তি হয়। ২০১৫ সালের ৪ জুন তার গলায় অস্ত্রোপচার হয়। এরপর আর জ্ঞান ফেরেনি তার। নয় দিন পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
চিকিৎসকের অবহেলার অভিযোগ এনে শারমিনের মা সুফিয়া সরকার উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন। তাতে বলা হয়, ফিরোজ আহম্মেদ খান শারমিনের অস্ত্রোপচার না করে তাঁর অধীনস্থ চিকিৎসক আবুল হোসেনের ওপর দায়িত্ব দিয়ে চলে যান। শারমিনকে অজ্ঞান করেন একই হাসপাতালের অবেদনবিদ ফাইজুল হোসেন চৌধুরী। তিনিও অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার আগে চলে যান। অস্ত্রোপচার চলার সময়ই রোগীর উচ্চরক্তচাপ দেখা দিলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের সময়ই অচেতন শারমিন ছটফট করতে শুরু করলে অস্ত্রোপচারকক্ষের সহকারী অবেদনবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান এম এ করিমকে ফোনে জানান। এরপর এম এ করিম ওয়ার্ডবয়কে ফোন করে রোগীকে ফেনটানিয়েল ইনজেকশন দিতে বলেন। এই ইনজেকশন প্রয়োগ করার কথা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী নয় দিন শারমিন ছিল লাইফ সাপোর্টে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ মেডিকেল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও এর অধীন উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুটি কমিটিই শারমিন সরকারের চিকিৎসায় অবহেলার প্রমাণ পায়। ২০১৫ সালের ২৯ জুন উল্লিখিত চার চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে ফিরোজ আহম্মেদ খান কাছে স্বীকার করেন, তিনি নিজে অস্ত্রোপচার করেননি। তিনি দাবি করেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকেরাও তো নিজেরা অস্ত্রোপচার করেন না। ফিরোজ আহম্মেদসহ অভিযুক্ত চার চিকিৎসকই প্রথম আলোর কাছে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
এদিকে দুটি কমিটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর ফিরোজ আহম্মেদের অনুরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরে একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ফিরোজসহ বাকি তিন আসামি এম এ করিম, আবুল হোসেন ও ফাইজুল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবহেলার প্রমাণ পায়নি বলে প্রতিবেদন দেয়।
এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) বাংলাদেশ মেডিকেল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্তকে আমলে নেয়নি। ডিবি মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে সুফিয়া সরকার আদালতে নারাজি দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জানুয়ারি আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা এই মামলার তদন্তে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন না। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনকে বেশি মূল্যায়ন করেছেন। আদালত পিবিআইকে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর ৩০ আগস্ট পিবিআইও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভিযোগ তদন্তের চেয়েও কেন সুফিয়া সরকার মামলা লড়ে যাচ্ছেন, কেউ তাঁকে প্ররোচনা দিচ্ছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা ছিল বেশি। এমনকি ওই ঘটনা সম্পর্কে জানেন বা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার সাক্ষ্য নিতে পারেনি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার সর্বশেষ তদন্ত (তদারক) কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, অন্য অনেককে তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি দাবি করেন, শারমিনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হয় এমন কোনো তথ্য তাঁরা পাননি।
তবে শারমিনের মা সুফিয়া সরকারের দাবি, তদন্তের দুর্গতির কারণে তিনি বিচার পাচ্ছেন না। পিবিআইয়ের তদন্তকারী দল তাঁর সঙ্গে কথাও বলেনি। তিনি বলেন, পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তিনি আদালতে নারাজি আবেদন দেবেন। এখন আদালতই তাঁর শেষ ভরসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *