রোহিঙ্গা সংকটে চীন নীরব কেন?

Slider সারাবিশ্ব

d7147be667981db2709016caee00961a-59ca9caba8b6f

 

 

 

 

চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল ভিত্তি তাদের ভাষায় অংশীদারত্বের সমৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ (Shared prosperity and destiny)। আর সেই অংশীদারত্বের সমৃদ্ধির জন্য বাণিজ্যের প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটানো। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য প্রয়োজন হয় স্থিতিশীলতা। সুতরাং, দেশটি এখন স্থিতিশীলতার পক্ষে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মহাপরিচালক ইউ জিনহুয়া এবং তাঁর দপ্তরের অন্য কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে গত দুই সপ্তাহে কয়েক দফা আলোচনায় এসব কথাই উঠে এসেছে। মি ইউ অবশ্য খোলাসা করে আরও একটি বিষয়ের কথা বলেছেন। তাঁর কথায় আমরা যা করছি তার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিন্দিত বা সমালোচিত (refrain from being criticised) না হওয়া। তিনি বলেন, চীন বিশ্বের নেতা হতে চায় না, সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব গড়তে চায়।
রোহিঙ্গা সংকটে চীনের অবস্থান নিয়ে আগ্রহ, উদ্বেগ এবং সমালোচনার অন্ত নেই। কারণ, মিয়ানমারের ওপর চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি মোটামুটি সবারই জানা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযান ও গণহত্যার বিষয়ে চীনের নীরবতাকে তাই দেশটির প্রতি সমর্থনের আভাস হিসেবেই কূটনীতিকদের অনেকে অভিহিত করছেন। তাঁদের কাছে নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।
মিয়ানমার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের আগেও সামরিক শাসনামলে দেশটির সঙ্গে চীনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। সু চির দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লিগ (এনএলডি) ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সে সম্পর্কে একটুও টান পড়েনি। কারণ, চীনের নতুন উন্নয়ন দর্শন ও কৌশলের ভিত্তি যে ঐতিহাসিক বাণিজ্যপথ—সেই ‘সিল্ক রোডের পুনরুজ্জীবন’-এর উদ্যোগ। মিয়ানমারের অবস্থান সেই সিল্ক রোডেরই একটি অংশে। সুতরাং, বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে সেই সম্পর্কের গুরুত্ব এখন আরও বেড়েছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মূলে আছে বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে পণ্য চলাচল সহজ করতে ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নের এক আন্তমহাদেশীয় মহাপরিকল্পনা। এটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই অথবা বি অ্যান্ড আর উভয় নামেই পরিচিত। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের প্রয়োজন এই পরিকল্পনার আওতায় থাকা দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা। চীন ইতিমধ্যে এই উদ্যোগের প্রতি ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোরালো সমর্থন পেয়েছে। এদের কারও সমর্থন হারানোই তার কাম্য নয়।
১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞের দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করলে বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে যায়। তার পরদিন আমার এক প্রশ্নের জবাবে পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের উপমহাপরিচালক শি গুহোই বলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধন ঘটে থাকলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি মর্মাহত হওয়ার কথা জানাবে। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা কেন উঠেছে সে কথা কেবল তিনিই বলতে পারেন। কিন্তু সেই একই দিনে চীনা পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জেং শুয়াং বলেন, ‘আমরা রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানাই। রাখাইনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মিয়ানমারের প্রয়াসের প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে।’ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং সরকারের মুখপাত্রের বক্তব্যের মধ্যে আপাতদৃশ্যে একধরনের ফারাক দেখা দেয়, যার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে পার্টির মুখপাত্র অবশ্য আগেই বলেছিলেন যে দলের বক্তব্য আর সরকারের বক্তব্য এক না-ও হতে পারে।
২৪ ঘণ্টা পরই দেখা গেল মিয়ানমারের সহিংসতার নিন্দা ও অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি, যাতে চীনেরও সমর্থন ছিল। কিন্তু এই বিবৃতি দেওয়ার তাৎপর্য অনেকটাই অলক্ষ্যে থেকে গেছে। সেই বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন এবং কর্তৃপক্ষের অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগের নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আর গত সোমবার চীনের জাতীয় দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত এই সংকট নিরসনে গঠনমূলক ভূমিকা রাখায় তাঁর দেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। কূটনীতির এই ভাষার মানে হচ্ছে তাঁরা তাঁদের প্রভাব কাজে লাগাতে রাজি আছেন। আরও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে চীনা রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা লোকজনকে ‘শরণার্থী’ অভিহিত করে তাদের প্রতি তাঁর দেশের সমবেদনার কথা জানিয়েছেন। স্পষ্টতই, মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি যে কোনো নিরাপত্তাজনিত সাধারণ বিষয় নয়, তার একটা স্বীকৃতি মেলে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে।
এ ধরনের ঘটনাক্রম নতুন নয়। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র এবং ইরানের প্রতি নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নেও এর আগে দেখা গেছে চীন পাশ্চাত্য, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব অনুমোদনের বিপক্ষে যাচ্ছে না। দু-একটি ক্ষেত্রে ভোটদানে বিরত থেকে প্রস্তাব পাস হতে দেওয়ার সুযোগও তারা দিয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর প্রধান ঝাং শি ই এশিয়ার ১৩টি দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলোচনায় বলেন যে চীন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব কঠোরভাবে মেনে চলেছে। তিনি বলেন, চীন কোনো সংঘাত চায় না, কোনো বিশৃঙ্খলা চায় না, কোনো যুদ্ধ চায় না।
ডোকলামে ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সৃষ্ট বিরোধের প্রসঙ্গ উঠলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এসব কর্তাব্যক্তি প্রত্যেকেই বলেছেন, চীন কখনোই ভারতকে শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না। ভারতও চীনকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে এমনটি আমরা মনে করি না। ফলে,
এই বিশ্বাসকে ভিত্তি করেই পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে। অনেক সমস্যারই উদ্ভব হতে পারে, যেগুলোর উৎস ইতিহাসে প্রোথিত উল্লেখ করে মি শি গুহোই বলেছেন, এগুলোর কারণে হাজার হাজার বছরের প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব নষ্ট হতে পারে না।
এশীয় সাংবাদিকদের মধ্যে মিয়ানমারেরও দুজন ছিলেন। তাঁদের একজন ইউনিয়ন ডেইলি পত্রিকার সাবেক প্রধান সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত মেজর উইন তিন। উইন তিন তাঁর বর্ণনায় পুলিশ ও নিরাপত্তাচৌকিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলাকে উত্তেজনার সূত্রপাতের কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সংকট নিরসনে চীন মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেবে কি না জানতে চান। মি শি মধ্যস্থতার প্রশ্নে কোনো জবাব দেননি। উত্তর কোরিয়া এবং ইরান সংকটের ক্ষেত্রে দেখা গেছে নীরব কূটনীতিতে চীন যতটা সক্রিয় থাকে, সাধারণত তা ততটা দৃশ্যমান হয় না। রোহিঙ্গা সংকটের প্রশ্নে পর্দার অন্তরালে চীনকে উদ্যোগ নিতে রাজি করানো যে অসম্ভব কিছু ছিল না তার প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং, স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে আমরা কি চীনের কাছে আরও আগেই এই সহায়তা চাইতে পারতাম না। আমাদের তাই এখন প্রয়োজন আত্মজিজ্ঞাসা যে আমরা সংকটের গুরুত্ব সময়মতো বুঝে উঠতে পেরেছিলাম কি না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, বি অ্যান্ড আরে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়েও বেশি অগ্রাধিকার পাবে কি না? মিয়ানমারে বিনিয়োগের পরিমাণ এবং সামগ্রিক বাণিজ্য সম্ভাবনাই সে রকম আভাস মেলে কি না? চীন মিয়ানমারের সঙ্গে গ্যাস ও খনিজসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন, গ্যাস পরিবহনের জন্য পাইপলাইন নির্মাণ, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং একটি অর্থনৈতিক এলাকা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একাধিক সহযোগিতা চুক্তি করেছে। এসব চুক্তির আর্থিক মূল্য শত শত কোটি ডলার। সুতরাং, সেই বিনিয়োগের সুরক্ষায় তাদের স্বার্থ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে সেই স্বার্থের সুরক্ষা থাকে কি? এমন মতও রয়েছে যে মিয়ানমারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ আকর্ষণে অন্য কিছু বৃহৎ শক্তি সেখানে অস্থিরতা তৈরি করতে চায়।
মিয়ানমারের সংকট নিয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসবে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো এর আগে জানিয়েছিল যে দুই সপ্তাহ আগে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়া এবং চীনের মনোভাবে মিয়ানমারের প্রতি সহানুভূতির ছাপ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি সর্বসম্মত বিবৃতিতে সহিংসতা বন্ধের দাবি উঠেছিল। এখন শরণার্থীদের প্রতি চীনের প্রকাশ্য সহানুভূতির পর বাংলাদেশ তা কতটা কাজে লাগাতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।
বি অ্যান্ড আরে যোগ দিয়েছে যেসব দেশ, বাংলাদেশও তাদের অন্যতম। গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন দুই দেশের মধ্যে প্রায় সাড়ে তেরো শ কোটি ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। তা ছাড়া বাণিজ্য চুক্তি হয়েছিল আরও প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের। সুতরাং, বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থও নগণ্য কিছু নয়।
স্পষ্টতই মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইতিহাস এবং মাত্রা বিবেচনায় হাত গুটিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা কোনো কাজের কথা নয়। এই সংকটে চীনের সহায়তা চাওয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণগুলো খুবই শক্তিশালী। বিশেষত চীনের ভাষায় এশিয়ায় যদি অংশীদারত্বের ভবিষ্যৎ বা সমৃদ্ধি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে এই সংকটে চীনকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলতে হবে। কারণ, এই সংকটের সমাধান হলে শুধু বাংলাদেশই লাভবান হবে তা নয়, এই অঞ্চলের সবাই লাভবান হবে। বিশ্বেও অন্তত একটি অশান্তির অবসান হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *