গবেষণায় পথ হারিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

Slider জাতীয় শিক্ষা
গবেষণায় পথ হারিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

২০১১ সালে ‘ফেজারভেরিয়া আসমতি’ নামে নতুন প্রজাতির ব্যাঙ আবিষ্কার করে দেশের প্রাণিবিদ্যাচর্চায় নতুন পথ দেখিয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ওই গবেষণার জন্য ২০১৩ সালে হেলসিঙ্কি কালচারাল ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডও পান গবেষক মোহাম্মদ সাজিদ আলী হাওলাদার। এর পর থেকেই যেন পথ হারিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণা। গত কয়েক বছরে উল্লেখ করার মতো কোনো গবেষণা নেই বিভাগটির।

দেশের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫টি গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে ২৮-৩০টিতেই কয়েক শিক্ষাবর্ষ ধরে মৌলিক কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই। এর মধ্যে কিছু গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মৌলিক কোনো গবেষণা হয়নি। গবেষণায় পথ হারিয়েছে প্রাচীন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও।

যদিও শিক্ষাবিদরা বলছেন, গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, বিকাশ ও বিতরণই হলো উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আর বিষয়ানুগ গবেষণার ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে উচ্চশিক্ষা।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে দেশের মোট ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটিই গবেষণার পেছনে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। কোনো গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি, এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১১টি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার দুরবস্থার কথা স্বীকার করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, একসময় মৌলিক গবেষণায় নেতৃত্ব দিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গবেষণায় অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে পুরনো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের। সে ঐতিহ্য ভুলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবাই এখন ডিগ্রি অর্জন ও প্রদানেই ব্যস্ত। গবেষণার দিকে কারো নজর নেই। বর্তমানে শিক্ষকরা বেশির ভাগ সময় পাঠদানে ব্যস্ত থাকেন। অবসরে গবেষণা করার কথা থাকলেও অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন তারা।

গবেষণার অতীত ঐতিহ্য হারিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বিবরণী (২০১৪-১৫) অনুযায়ী, ওই শিক্ষাবর্ষে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষকের কোনো ধরনের গবেষণা, প্রবন্ধ বা প্রকাশনা ছিল না। একইভাবে কোনো ধরনের গবেষণাকাজে ছিলেন না আইন অনুষদের ৯৫, কলা অনুষদের ৭৫ ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৯০ শতাংশ শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে ৪৫টির মতো। এর মধ্যে কিছু কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনই কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি। অথচ গবেষণাকাজে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে। এর বেশির ভাগই খরচ হয় সভা-সেমিনারে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, গবেষণাকেন্দ্রগুলোকে মৌলিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই ছিল গবেষণা। তবে অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না থাকায় কাঙ্ক্ষিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার পরও প্রতি বছরই এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে।

দেশের আরেক ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন উচ্চশিক্ষালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম আশির দশকে গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গবেষণাকেন্দ্রটি দেশের উচ্চতর গবেষণায় অবদান রাখলেও বর্তমানে কার্যত অচল।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণায় বরাদ্দও অপ্রতুল। ২০১৭-১৮ অর্থবছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের দশমিক ৬৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সর্বশেষ অর্থবছর ইউজিসির কাছে ৪১২ কোটি ৮২ লাখ টাকার বাজেট বরাদ্দ চাওয়া হলেও দেয়া হয় মাত্র ২৯৫ কোটি টাকা। বেতন-ভাতা খাতেই এ বরাদ্দ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এতে গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে।

গবেষণাচিত্র হতাশাজনক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরও। এক শিক্ষাবর্ষের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে এমফিলে ১১৬ ও পিএইচডি প্রোগ্রামে ৫১ জন গবেষক ভর্তি হন। আর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে এমফিলে ভর্তিকৃত গবেষকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৯ ও পিএইচডিতে ২২। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণায় অংশগ্রহণের হার কমেছে ৫৮ শতাংশ।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ে অধিকাংশ বিভাগের নিজস্ব গবেষণাগার থাকলেও পূর্ণাঙ্গ গবেষণার জন্য নেই পর্যাপ্ত সরঞ্জাম। শিক্ষকদের হিসাবমতে, চাহিদার ২৫-৩০ শতাংশ সরঞ্জাম আছে গবেষণাগারগুলোয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মতে, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না গবেষকরা। বিশেষ করে বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলোয় পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। অপ্রতুল বরাদ্দে গবেষণা সরঞ্জাম কিনতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় গবেষকদের ছুটতে হচ্ছে পার্শ্ববর্তী রুয়েট, ধান গবেষণা কেন্দ্র ও বিসিএসআইআরে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ গবেষণাবান্ধব নয়। গবেষণায় তেমন কোনো প্রণোদনা নেই। এখনকার শিক্ষার্থীরাও গবেষণা করতে চান না। পদোন্নতি বা নিয়োগের ক্ষেত্রেও গবেষণার মূল্যায়ন হয় না। এসব কারণে গবেষণায় উত্সাহ হারাচ্ছেন গবেষকরা। উচ্চশিক্ষার জন্য এটা অশনিসংকেত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *