তার পরও মহানায়কের রাজসিক আগমন…

Slider জাতীয়
তার পরও মহানায়কের রাজসিক আগমন...

মহানায়ক পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন— দেশময় হয়েছে সেকথা। তার প্রস্থানে শোকে বিহ্বল সিনেমা দেখা না দেখা প্রতিটি মানুষ। অঝোর ধারায় সারা রাত প্রকৃতিও হয়তো কেঁদেছে তার শূন্যতায়। ঘোষণা ছিল বেলা ১১টায় (গতকাল) মহানায়ক কাছের মানুষদের কাঁধে চড়ে আসবেন নিজের প্রিয় স্থান এফডিসিতে। তাই কাকডাকা ভোর থেকেই মানুষের ঢল নামে সেখানে প্রিয় অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাককে একনজর দেখার জন্য। হাজারো ভক্তের শোকের নিস্তব্ধতা রাজপথের কোলাহলকেও যেন তখন হিম-শীতল করে দিয়েছিল।

বেলা ১১টা। দুই ধারে দাঁড়ানো হাজারো মানুষ, এরই মাঝ দিয়ে কিংবদন্তি এগিয়ে চললেন তার কর্মস্থল এফডিসির দিকে। তাকে বহনকারী গাড়িটি ধীরে ধীরে পৌঁছাল জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে। আগে থেকে তৈরি রাখা তার জন্য নির্ধারিত মঞ্চটি মুহূর্তেই ভরে উঠল ফুলে ফুলে; নবীন-প্রবীণ সহকর্মীর আর্তনাদে বাতাসও যেন ভারী হতে থাকে। শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে একপলক দেখার জন্য আগতদের সেকি আবেদন!

নায়ক রাজ্জাকের মরদেহের কফিন থেকে একটু দূরে বসে আছেন তার দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট। অঝোর ধারায় কাঁদছেন তারা। কাছে যেতেই না সূচক ইঙ্গিত দিলেন দুজনই। কথা বলতে গিয়েও আবার চুপ হয়ে গেলেন। বাবার  মরদেহের জানাজা শুরুর আগ মুহূর্তে বাপ্পারাজ মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলেন, ‘আমার বাবা চলে গেছেন, সবাই দোয়া করবেন তার জন্য। চলচ্চিত্র জীবনে অনেকটা সময় তিনি আপনাদের সঙ্গে থেকেছেন, হয়তো তার কিছু ভুলভ্রান্তিও থাকতে পারে, অনুরোধ করছি, সেগুলো মার্জনার চোখে দেখবেন। শোকগ্রস্ত সন্তানের মুখ আবেগভরা এ কথায় আরেকটিবারের জন্য চারপাশ থেকে আর্তনাদ ভেসে আসে তখন।

রাজ্জাকের হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে এসেছিলেন অভিনেত্রী অঞ্জনা ও জাভেদ। তাদের দিগভ্রান্ত ছোটাছুটি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, কতটা শোকে কাতর তারা! অঞ্জনার কাছে যাওয়া মাত্রই আওড়ালেন, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে— গানটি কবে থেকে সবার মুখে মুখে। এ ‘অশিক্ষিত’ ছবি দিয়েই চলচ্চিত্রে আমার উত্থান। আমার ক্যারিয়ার শুরু তার হাত ধরে। শুধু আমি কেন, আমার মতো অন্য অভিনেত্রীরাও যারা তার সঙ্গে কাজ করেছেন, কেউ কোনো দিন তাকে ভুলতে পারবেন না। তার কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। মহানায়ক, আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন না কখনো।’ অঞ্জনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন জাভেদ। তিনি স্মৃতি হাতড়িয়ে জানালেন: শুটিং করতে গিয়ে রাজ্জাক একদিন পানির ভেতর পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। এর পর তিনি সারা রাত তার সেবা শুশ্রূষা করেছেন। সকালে রাজ্জাক ঘুম থেকে জেগে জাভেদকে দেখে বলেছিলেন, ‘জাভেদ তুমি এখানে কী করছ? আরে আমি তো মরে যাইনি।’ তখন জাভেদের উত্তর নাকি এমনই ছিল: ‘সৃষ্টিকর্তা আপনার মতো ভালো মানুষকে আরো দীর্ঘজীবী করুন।’

চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির একতলা ভবনটির ভেতর ঢুকতেই পাওয়া গেল, সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, শাবনূর আলমগীরসহ বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য স্বনামধন্য কলাকুশলীকে। শত মানুষের মাঝেও অত বড় জায়গাটিতে যেন রাজ্যের নিস্তব্ধতা ভর করেছে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। সুচন্দা-ববিতা কিছুক্ষণ পর পর একে অন্যকে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। খানিকক্ষণ বাদে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখী হয়ে সুচন্দা রাজ্জাকের সঙ্গে তার পুরো জীবনের স্মৃতি তুলে আনলেন। বললেন, ‘রাজ্জাক ভাই চলে গেছেন, এ সংবাদ শোনার জন্য এক মুহূর্তেও প্রস্তুত ছিলাম না। যেদিকে তাকাচ্ছি, মনে হচ্ছে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, কথা বলছেন। কারণ নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘বেহুলা’। আর সে ছবির নায়িকা ছিলাম আমি। পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে প্রায় ৩০টির মতো ছবি করেছি তার সঙ্গে। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো এ এফডিসিতে রাজ্জাকের সঙ্গে কাটিয়েছি। একদিন দেখা না হলে, কথা না বললে কখনই ভালো লাগত না। জানি না, প্রিয় এ মানুষটির অনুপস্থিতি আমাকে কতটা ভোগাবে! তার পরও নায়ক রাজ্জাক নায়কোচিতভাবেই বিদায় নিয়েছেন— এটাই আমার গর্বের জায়গা।’ সুচন্দার পাশে বসেছিলেন অভিনেত্রী ববিতা। ববিতার প্রথম ছবিও ছিল রাজ্জাকের বিপরীতে। প্রথম এ ছবিতে রাজ্জাকের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কান্নামিশ্রিত স্বরে সে গল্পও বললেন এভাবে: ‘রাজ্জাক ভাই এ ছবিতে আমার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর সুচন্দা মায়ের। এর পর দ্বিতীয় ছবিতেই তিনি আমার নায়ক হলেন। তখন আমি শুটিং করতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, যাকে কয়েক দিন আগে বাবা ডেকেছি। সেই তার বিপরীতেই প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে! এর পর জহির ভাই (জহির রায়হান) আমাকে বকা দিয়ে বললেন, ‘ঠিক করে অভিনয় করো।’ তার কথা শেষ না হতেই শাবনূর টকিজকে বললেন, ‘রাজ্জাক চাচার সঙ্গে আমার কম অভিনয় করা হয়েছে। বেশির ভাগ ছবিতেই তিনি আমার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। উনি যখন সেটে থাকতেন, তখন খুনসুটি করতেন। সেগুলো এখন মনে পড়ছে। একবার বিমানযাত্রায় তার সহসঙ্গী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন উনি যেভাবে আমাকে খেয়ালে রেখেছেন, তাতে মনে হয়েছিল আমার বাবা আমাকে যত্ন করছেন। তাকে নিয়ে বলার মতো আর কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’ অভিনেতা, আলমগীর, ফেরদৌস, মিশা সওদাগর, জায়েদ খান, অভিনেত্রী চম্পা, পপি, শিমলা,  শবনম বুবলীসহ আরো অসংখ্য কলাকুশলীর কাছ থেকে এ রকম অগণিত স্মৃতি গোটা এফডিসি প্রাঙ্গণে ছোটাছুটির মাঝখান দিয়েই ঘোষণা এল, রাজ্জাক শেষবারের মতো বিদায় নিচ্ছেন বাংলা সিনেমার সবচেয়ে আলোকিত জায়গা থেকে, যে জায়গাটি তাকে বানিয়েছিল আজকের কিংবদন্তি— মহানায়ক রাজ রাজ্জাক। তখন বাজে ঠিক বেলা ১১টা ৫০।

বেলা ১২টা ১৫। এফডিসি থেকে বেড়িয়ে যানজট পেরিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে শহীদ মিনারে পৌঁছে গেছেন মহানায়ক। মানুষে ভরপুর এফডিসির সেই দৃশ্য ফের ধরা দিল শহীদ মিনারে। আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা মানুষ প্রিয় অভিনেতা রাজ্জাককে রাজসিক বিদায় জানাতে তার কফিনের ওপর ফুল দিলেন, কাঁদলেন, কাঁদালেন। এদিকে এফডিসিতে যে তারকারা যাননি, তাদের অনেকেই এসেছিলেন শহীদ মিনারে। অভিনেত্রী জয়া আহসানও তাদের একজন। তিনি বিনম্র শ্রদ্ধায় সিনেমার এ অভিভাবককে বিদায় জানিয়েছেন।

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনও শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, বিএনপির পক্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এছাড়া বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ, মুক্তধারা সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রসহ অসংখ্য সংগঠন।

অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের মতাদর্শিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে যেভাবে মহানায়ককে বিদায় জানালেন, তাতে সত্যিই কিংবদন্তি এ অভিনেতা আবারো নতুন করেই আগামী প্রজন্মের সামনে এসে দাঁড়ালেন, সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *