পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি

Slider গ্রাম বাংলা
নদী বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

বৃষ্টি বন্ধ হওয়া এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের প্রবাহ কমে আসায় বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। ফলে গতকাল দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে।

তবে ধস ও ভাঙনসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি মোটেও কমেনি। বরং নদী ভাঙন, বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং দুর্গত এলাকায় নানা বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ—গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় করতোয়া ছাড়া সব নদ-নদীর পানি প্রতিদিনই কমছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীর বাঁধ ও বাঙ্গালী নদীর বাঁধ ভেঙে গতকাল আরও ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জে পানিতে ডুবে জিনাত হোসেন (৩) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দুপুরে তালুক কানুপুর ইউনিয়নের শিবশহর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। জিনাত ওই গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, করতোয়ার পানি ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালী পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তামুখ ঘাটে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি শহর পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তার পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে।

কুড়িগ্রাম : ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি বানভাসিদের। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এখনো তলিয়ে আছে চরাঞ্চলের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি। বাড়িতে ফিরতে পারছেন না বানভাসিরা। উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও নৌকায় বসবাস করছে দুর্গম চরাঞ্চলের বানভাসি পরিবারগুলো। এদিকে টানা ৭ দিন পানিবন্দী থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছেন বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। বন্যাদুর্গত এলাকায় চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। নৌকা দেখলেই ছুটছেন বানভাসিরা। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতায় দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যাদুর্গতদের ভাগ্যে জুটছে না কিছুই। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি ধীরগতিতে কমছে। ৪৮ ঘণ্টায় মাত্র ১৬ সেন্টিমিটার পানি কমে বিপদসীমার ১৩৬ প্রবাহিত হওয়ায় এখনো দুর্ভোগ কমেনি। পানিবন্দী মানুষ গরু-ছাগলের সঙ্গে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ কেজি চাল ও চিড়া-গুড় মুড়ি বিতরণ করা হলেও শিশু খাদ্য বিতরণ না করায় বিপাকে রয়েছেন বানভাসিরা। চরাঞ্চলের টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ সার্বক্ষণিক পানিতে চলাফেরা করায় তাদের হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে গো-খাদ্য সংকট। বেলকুচি পৌরসভার বিভিন্ন দোকানপাট-তাঁত কারখানায় পানি ওঠায় তাঁত ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করেছে। জামালপুর : যমুনার পানি কমতে থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি ২২ সেন্টিমিটার কমে গতকাল সকালে বিপদসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে গতকাল দুপুরে মাদারগঞ্জের বালিজুড়ি গ্রামে বন্যার পানিতে গোসল করতে নেমে ডুবে মারা গেছে পাপসি (১৩) ও ভাবনা (১২) নামে দুই শিশু। সন্ধ্যায় তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নাটোর : নাটোরের নলডাঙ্গায় কয়েক দিনের অবিরাম ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বারনই নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ও হালতি বিলে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে এবং তলিয়ে যাচ্ছে আমন ধান। এ ছাড়া সিংড়ায় আত্রাই নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি কমলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ১৯ সেন্টিমিটার কমে বর্তমানে বিপদসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির প্রবল চাপে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের যে স্থানগুলো ঝুঁকির মধ্যে ছিল, বর্তমানে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করেছে। জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানিসহ খাবার সংকট তীব্র হয়েছে। এখনো বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ৯১টি গ্রামে পানি রয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী আছেন। অপরদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিনই বন্যাকবলিত এলাকা থেকে লোকজন আশ্রয় নিচ্ছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর।   রাজশাহী : বাগমারা উপজেলায় বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের শালজোড় শ্মশানঘাট এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত নারীর নাম জয়নব বিবি (৪২)। তিনি একই ইউনিয়নের রমজানপাড়া গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে রমজানপাড়া গ্রামের বন্যায় ভেঙে যাওয়া রাস্তার ওপর হাঁটতে গিয়ে পানিতে পড়ে যান জয়নব। সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থানীয়রা চেষ্টা চালিয়েও তার সন্ধান পাননি। পরে তাদের সঙ্গে দমকল বাহিনীর ডুবুরিরাও যোগ দেন। কিন্তু তারাও জয়নবকে উদ্ধারে ব্যর্থ হন। নওগাঁ : নওগাঁয় বন্যার পানি ডুবে অজিত চন্দ্র (৫৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি মিরাট ইউনিয়নের কুনুজ গ্রামের মৃত শশী চন্দ্র মণ্ডলের ছেলে। রানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অজিত সকালে বেড়ি বাঁধে কাজ করার সময় বন্যার পানিতে পড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। শরীয়তপুর : পদ্মার পাড়ের আশপাশের আরও ৩৫টি গ্রাম গতকাল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার নড়িয়া, জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকায় বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভাঙন কবলিত হয়েছে। জানা গেছে, সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নড়িয়া-জাজিরার প্রায় ৩ কিলোমিটার সড়কের ওপর দিয়ে পানি বইছে। পানি ঢুকতে শুরু করেছে জেলার ছোট নদীগুলোর শাখা দিয়ে। এ অবস্থায় নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

ফরিদপুর : ফরিদপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ফরিদপুর পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন তা বিপদ সীমার ১০৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বৃদ্ধির ফলে ফরিদপুরের নিচু এলাকা ও চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে গতকাল পর্যন্ত জেলার তিনটি উপজেলার ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে ছিলেন। এ ছাড়া বেশকিছু সড়ক ডুবে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মাদারীপুর : পদ্মায় অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় তীব্র স্রোতে গুরুত্বপূর্ণ শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়ে কাঁঠালবাড়ি ঘাট এলাকায় বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির তোড়ে মাদারীপুরের শিবচরের পদ্মা বেষ্টিত জনবিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের কাঁঠালবাড়ি ও চরজানাজাত, মাদবরচর ও বন্দরখোলা এবং সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নে ব্যাপক নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব জায়গায় পানিবন্দী হয়ে আছেন কয়েক হাজার মানুষ। জানা গেছে, কাঁঠালবাড়ির ৪টি ফেরিঘাটের মধ্যে ৩টি ঘাটের কিছু অংশ পানিতে ডুবে গেছে। ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি ফেরিতে ওঠা-নামা করছে। বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ম্যানেজার আ. সালাম বলেন, ৪টি ঘাটের মধ্যে ৩টিতেই পানি রয়েছে। ফেরি চলাচল করলেও ব্যাহত হচ্ছে। দোহার (ঢাকা) : রাজধানী ঢাকার অতি নিকটে অবস্থিত পদ্মা নদীর তীরবর্তী দোহার উপজেলার নয়াবাড়ী, মাহমুদপুর ও বিলাশপুরসহ ইউনিয়নসহ নিম্নাঞ্চলসমূহ পদ্মার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কৃষিজমি পানিতে ডুবে গেছে। বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ২দিনে দোহার নবাবগঞ্জে ৫০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল দুপুরে দোহারের মাহমুদপুর ও  বিলাশপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।   এ ছাড়া বানের পানিতে তলিয়ে গেছে নারিশা ও নয়াবাড়ীর বেশিরভাগ গ্রাম ও রাস্তাঘাট। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ১০/১২ হাজার পরিবার। তাদের হাট বাজারে যেতে একমাত্র বাহন এখন নৌকা ও কলার ভেলা। সরেজমিন দোহারের নয়াবাড়ী ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, বন্যার পানিতে অনেক গ্রামের ঘরবাড়ি ডুবে আছে। কাঁচা পাকা রাস্তা এবং ছোট ছোট সেতু ডুবে গেছে। এলাকার সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা পানি মাড়িয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কাজে যাতায়াত করছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদিপশু ও হাঁস মুরগি রাস্তায় তুলেছেন। পানিতে ডুবে গেছে বিলাশপুরের মাঝিরচর, মধুর চর, রাধানগর, হাজার বিঘা, নারিশা জোয়ার, মাহমুদপুরের হরিচন্ডী, নারায়ণপুর, চর কুশাইর চর জামার চরসহ প্রায় ৩০টি গ্রাম। চাঁদপুর : বন্যার পানির চাপে চাঁদপুরের মেঘনা নদী তীরবর্তী এলাকা রাজরাজেশ্বর লক্ষ্মীপুর, ইব্রাহীমপুর, হানারচর, নীলকমল ইউনিয়নের কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। দুই দিনে নদীতে বিলীন হয়েছে অর্ধশতাধিক বসতভিটা। অবশ্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪নম্বর রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে অবস্থিত লগ্মিমারা আশ্রয়ণ কেন্দ্রটি। এরই মধ্যে ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই তাদের বাসস্থান ও বিভিন্ন মালামাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *