পানিতে তলিয়ে থাকা অগণিত বন্যার্ত মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন খাদ্য। দুর্গতদের সিংহভাগই খাবার পাচ্ছেন না।
তারা না খেয়ে কিংবা অর্ধাহার-অনাহারে সময় পার করছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহল ত্রাণ তত্পরতা চালালেও তা প্রকৃত দুর্গতদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে সর্বস্ব হারানো এসব মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুঃসহ এবং অবর্ণনীয়।এদিকে দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলেও কোনো কোনো অঞ্চলে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে দুর্গত এলাকায়। ফলে কোথাও কোথাও পানি সামান্য পরিমাণে নেমেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, চলতি বন্যার দ্বিতীয় দফায় এ পর্যন্ত পাউবোর এক হাজার ৯০০ কিলোমিটার বাঁধের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর জানাচ্ছে, বন্যায় ২২ জেলার ৩৩ লাখ ২৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর ও রাঙামাটি জেলার ১২২টি উপজেলা ও ৩৮টি পৌরসভা এখনো প্লাবিত রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত দেশের ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ৪৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ৪০টি পয়েন্টে হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া ২৮টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গতকাল পাঠানো আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে তা এখনো বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্ট ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার কমলেও তা বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপরে আছে। ধরলার পানি বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে এ অঞ্চলের বানভাসিরা। জেলার ৯ উপজেলার ৮২০ গ্রামের ৪ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী জীবনযাপন করছে। তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশুসহ পাকা সড়ক, উঁচু বাঁধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট। ত্রাণের নৌকা দেখে বানভাসিরা ছুটে গেলেও বেশির ভাগের ভাগ্যেই ত্রাণ জুটছে না। সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তত্পরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জানা গেছে, বন্যায় পাঁচ দিনে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের বেশির ভাগই শিশু।
লালমনিরহাট : তিস্তার অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ধরলার তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ৭ দিনেও স্বাভাবিক হয়নি লালমনিরহাটের ট্রেন যাতায়াত ব্যবস্থা। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়ে চরম খাদ্য সংকট। ছড়িয়ে পড়েছে নানা পানিবাহিত রোগ। গতকালও জেলার ৩টি হাসপাতালে ৫৩ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। এদিকে লালমনিরহাট রেল বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় রেললাইনের নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে রাস্তা ধসে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে আরও কত দিন সময় লাগবে- তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি রেল বিভাগের কোনো কর্তাব্যক্তিই। তবে লালমনিরহাট রেল বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে আরও ১৫ দিন লাগতে পারে। অন্যদিকে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো বন্যার পানি থাকায় কবলিত এলাকার ৩২৫টি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট থেকে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
দিনাজপুর : দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের কিছু অংশ এখনো পানির নিচে ডুবে আছে। তবে সব নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় দিনাজপুর সদর উপজেলার কাউগাঁও এলাকায় রেললাইন ছাড়াও আরও কয়েকটি স্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনো দিনাজপুরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর সড়ক-মহাসড়ক ও রাস্তাঘাট ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। এতে অনেক সড়কেই যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকার পানি কমতে শুরু করলেও বেড়েছে খাদ্য সংকট ও রোগবালাই। প্রশাসনের ১২৫টি স্বাস্থ্য ক্যাম্পের পাশাপাশি বন্যাদুর্গতদের চিকিৎসা দিচ্ছেন সেনা ও বিজিবির সদস্যরা।
সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১২ ঘণ্টায় চার সেন্টিমিটার কমে এখনো বিপদসীমার ১৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫ উপজেলার তিন শতাধিক গ্রামের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী। এর মধ্যে অনেকে ওয়াপদা বাঁধে পলিথিন ও টিন দিয়ে ঝুপড়ি তুলে, অনেকে নিজ বাড়িতেই খাট-চৌকি উঁচু করে, আবার কেউ ঘরের চালে উঠে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চরাঞ্চলের টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ সার্বক্ষণিক পানিতে চলাফেরা করায় তাদের হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। রান্না করার উপকরণ না থাকায় অনেকে অর্ধাহার-অনাহারে দিনযাপন করছে। এসব মানুষ অবিলম্বে শুকনো খাবার ও ওষুধের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানিয়েছে। সরকারিভাবে ৩৩৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ সাড়ে ১২ লাখ টাকা বিতরণ করা হলেও তা অনেকের কাছে পৌঁছেনি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কোথাও কোথাও পানি চুইয়ে চুইয়ে ঢোকায় শহরের মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিকে বেলকুচিতে বন্যার পানি ও পুকুরের পানিতে পড়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরা হলো রাজাপুর ইউনিয়নের নাগগাতী গ্রামের আবদুল আওয়ালের ছেলে নিরব (৬) ও দৌলতপুর ইউনিয়নের বওড়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের ছেলে হযরত আলী (৮)।
টাঙ্গাইল : যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় টাঙ্গাইলের নাগরপুর, কালিহাতী, মির্জাপুর, বাসাইল, গোপালপুর ও ভূঞাপুরে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ৭টি উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। বন্ধ রয়েছে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় গোপালপুর-তারাকান্দি সড়কে সব প্রকার যানবাহন চলাচলও বন্ধ রয়েছে। জামালপুরের তারাকান্দি-গোপালপুর-ভূঞাপুর সড়কের পিংকনা অংশের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় গোপালপুর ও ভূঞাপুরের অন্তত ১০টি গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে।