রাজধানীর তিন আন্ডারপাসের দুটিই কাজে আসছে না

Slider ঢাকা

base_1501007662-r56সড়কের ওপারে যাওয়ার অপেক্ষায় কয়েকজন পথচারী। ইতি-উতি তাকাচ্ছেন সবাই। গাড়ির সংখ্যা একটু কমতেই কয়েকজনের ভোঁ-দৌড়। দৃশ্যটি দাঁড়িয়ে দেখলেন আরো কয়েকজন। পরেরবার ঝুঁকি নিয়ে পার হলেন তারাও। রাজধানীর গাবতলী বাসটার্মিনালের সামনে এটা নিত্যদিনের দৃশ্য। মাত্র ১০০ মিটার দূরত্বে আন্ডারপাস থাকলেও সেটি এড়িয়ে ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন অনেকে।

পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার্থে রাজধানীর গাবতলী, কারওয়ান বাজার ও গুলিস্তানে বানানো হয়েছে তিনটি আন্ডারপাস। এর মধ্যে কারওয়ান বাজারের ‘প্রজাপতি গুহা’ আন্ডারপাসটি মোটামুটি ব্যবহার হলেও বাকি দুটি এড়িয়ে চলছেন বেশির ভাগ পথচারী। একটিতে ভুতুড়ে পরিবেশ। অন্যটিতে হকারদের দৌরাত্ম্য ব্যবহারবিমুখ করে তুলছে পথচারীদের। এজন্য ব্যবস্থাপনা দুর্বলতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আন্ডারপাসগুলোর অবস্থানগত পরিকল্পনা শুরুর দিকে ঠিকই ছিল। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে এগুলো ব্যবহার করছে না পথচারী। ব্যবস্থাপনা ভালো হলে পথচারী এগুলো ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। গাবতলী ও গুলিস্তান আন্ডারপাসের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণেই মানুষ তা ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কারওয়ান বাজারেরটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেখভাল করে। এ কারণে সেটির মান কিছুটা ভালো।

আন্ডারপাস বা ফুটওভার ব্রিজ বানিয়েই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব দায় শেষ করে জানিয়ে তিনি বলেন, আন্ডারপাস বানানো হলো ভালো কথা। সেগুলো তো দেখভালও করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেটা করে না। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলো আন্ডারপাস ব্যবস্থাপনায় ভীষণ রকম উদাসীন ও অদক্ষ।

পথচারীদের অভিযোগ, ভুতুড়ে পরিবেশ, হকারদের দৌরাত্ম্য, ভাসমান মানুষ ও ভিক্ষুকদের উপস্থিতি, পকেটমারের উৎপাতসহ নানা কারণে আন্ডারপাস ব্যবহারে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন তারা। এত গেল দিনের অবস্থা। রাতের চিত্রটি আরো ভয়াবহ। আঁধার নামতেই আন্ডারপাসগুলোর দখল নেয় মাদকসেবীরা। থাকে ছিনতাইকারীরসহ ছোটখাটো অপরাধীদের উপস্থিতিও।

গতকাল রাজধানীর গাবতলী আন্ডারপাসে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে মনোরম পরিবেশ। চকচকে টাইলসের মেঝে। দেয়ালজুড়ে নানা শিল্পকর্ম।

উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত গোটা এলাকা। সবই আছে, নেই শুধু পথচারী। টার্মিনালপ্রান্ত থেকে নেমে অন্য প্রান্তে উঠতেই দেখা মিলল মাত্র একজনের। তবে তিনি পথচারী নন। ঘুমের ঘোরে থাকা একজন ভাসমান মানুষ।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা মিলল এক নারীর। দ্রুত বেগে পার হলেন। বের হওয়ার পর কথা হলে জানালেন, ‘ভেবেছিলাম ভেতরে অনেক মানুষের চলাচল থাকে। নেমে দেখি কেউ নেই। ভয় লাগছিল ভীষণ। তাই দ্রুত পার হয়েছি।’

গাবতলীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ওই নারী আন্ডারপাস ব্যবহারের পর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, ‘ঢাকা শহরে দিনের বেলায় এমন ভুতুড়ে জায়গা থাকতে পারে, জানতাম না! সঙ্গে কেউ না থাকলে এটি আর ব্যবহার করব না।’

আন্ডারপাসের টার্মিনাল প্রান্তের দেয়ালঘেঁষা একটি দোকানে চা বিক্রি করেন মো. বাবুল। পথচারীদের আন্ডারপাস ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুর দিকে মানুষের যাতায়াত ভালোই ছিল। এখন কমে গেছে।

আন্ডারপাসের ভেতরে একটি গার্ডকক্ষ থাকলেও সেটি তালাবদ্ধ। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও গার্ডের হদিস মেলেনি।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গুলিস্তান আন্ডারপাসের চিত্রটি এর একেবারে উল্টো। নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। হাঁকাহাঁকিতে সরগরম ভেতরের পরিবেশ। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে পথচারীদের চলাচলের জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্ডারপাসটি শুরু থেকেই মার্কেট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও সেটি বন্ধ থাকে বেশির ভাগ সময়। দিনে উৎপাত হকারদের আর রাতে মাদকসেবীদের। মাঝে মধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে।

আন্ডারপাসটির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বেলাল বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা প্রায়ই অভিযান চালিয়ে হকারদের উচ্ছেদ করি। কিন্তু অভিযান শেষ হতে না হতেই তারা আবার বসে যান। প্রয়োজনীয় আইন না থাকাসহ নানা কারণে হকারদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আন্ডারপাসটি জনবান্ধব করতে হকারদের উচ্ছেদের কোনো বিকল্প নেই।

গাবতলী ও গুলিস্তানের তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থা কারওয়ান বাজারের ‘প্রজাপতি গুহা’। এটিতে পথচারী চলাচল অন্য দুটির তুলনায় বেশি। তবে নানা সমস্যায় এটি আজ বেহাল। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সিঁড়িগুলো ভীষণ রকম অসমতল। অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা। ভেতরের পরিবেশও স্যাঁতসেঁতে। জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। ইট ফেলে কোনো রকমে চলছে পারাপার।

জানা যায়, প্রথম দিকে সিঁড়িগুলো অসমতল ছিল না। চলতি বছরের শুরুতে এটি সংস্কারের উদ্দেশ্যে সবক’টি সিঁড়ি ভেঙে ফেলা হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ ফেলে রাখার পর শুরু হয় সংস্কার কাজ। ছড়ানো-ছিটানো ভাঙা টাইলস ও কংক্রিটের টুকরা ডিঙিয়ে ওই সময় পার হতেন পথচারী। এভাবে চলতে গিয়ে অনেকেই পড়তেন দুর্ঘটনায়।

সংস্কারের পর দেখা দেয় নতুন সমস্যা। সিঁড়িগুলোর একটি ধাপের সঙ্গে পরেরটির দূরত্ব-পুরুত্বে বেশ গরমিল, যা প্রায়ই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠছে। সিঁড়ির নড়বড়ে টাইলসেও রয়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

প্রজাপতি গুহা আন্ডারপাসটি নিয়মিত ব্যবহার করেন কারওয়ান বাজারের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রমজান আলী। তিনি জানান, শুরুর দিকে অবস্থা বেশ ভালো ছিল। মনোরম পরিবেশ, দেয়ালজুড়ে শিল্পকর্মের পাশাপাশি ছিল টিভির ব্যবস্থা। যত দিন যাচ্ছে, পরিবেশ ততই খারাপ হচ্ছে। এখন টিভি তো নেই-ই, উল্টো কাদা-পানিতে একাকার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *