ভূমধ্যসাগরে ডিঙি নৌকায় আর মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার নানা রুটে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাত্রায় বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তারের হার বাড়ছে। বাংলাদেশের এসব মানুষকে ফিরিয়ে আনতে এবার কড়া শর্ত জুড়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
ইইউ এখন বলছে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের তালিকা বাংলাদেশকে দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ওই ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আটক ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফিরতে বাধ্য করা হবে।
গত বুধবার ব্রাসেলসে বাংলাদেশ-ইইউ যৌথ কমিশনের বৈঠকে ২৮ দেশের ইউরোপীয় জোটটি এই প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন শর্ত যুক্ত করে সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি এসওপি চূড়ান্ত করতে চায় ইইউ। কিন্তু এমন প্রস্তাবে সাড়া দিতে বাংলাদেশ অপারগতা জানিয়েছে।
ব্রাসেলসে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে নতুন করে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি শ্রম অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ে কঠোর মনোভাব দেখায় ইইউ। কিন্তু দুটি প্রসঙ্গেই মতপার্থক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত বৈঠক শেষে কোনো যৌথ বিবৃতি প্রচার করা হয়নি।
বুধবারের আলোচনায় উপস্থিত বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যৌথ কমিশনের গতকালের বৈঠকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত ও শ্রম অধিকারের প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের নতুন নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড, মানবাধিকার, বৈদেশিক অনুদান আইন ইত্যাদি প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রেক্ষাপট থেকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ইইউ বেশ জোরেশোরে কথা বলবে—এমন প্রস্তুতি থাকলেও প্রসঙ্গটি তেমন গুরুত্ব পায়নি।
ইউরোপে অবৈধ প্রবেশের সময় আটক হওয়া লোকজনকে ফেরতের প্রসঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এক সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনায় বেশ অনমনীয় অবস্থান তুলে ধরে ইইউ। দুই পক্ষের আলোচনার ধারাবাহিকতায় এবার কথা ছিল এক বছর ইইউর দেওয়া খসড়া চুক্তির আলোকে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) চূড়ান্ত করার বিষয়ে কথা হবে। কিন্তু বুধবারের বৈঠকে ইইউ প্রস্তাব করে, তাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী দুই দিনের মধ্যে আটক লোকজনের পরিচয় বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে দুই দিনের সময়সীমা শেষে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি পরবর্তী সময়ে ফেরত পাঠানো লোকজন বাংলাদেশি নয় এমনটা নিশ্চিত করতে পারে, তবে এমন ব্যক্তিকে আবার ফেরত নেওয়া হবে। নতুন প্রস্তাব মেনে নিয়ে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসওপি চূড়ান্ত করতে বলে ইইউ। গতকালের বৈঠকেই হঠাৎ করে লোকজনকে দুই দিন পর বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা প্রথমবারের মতো তোলা হয়। এর আগে তারা শুধু দুই দিনের মধ্যে লোকজনের পরিচয় নিশ্চিত করার কথা বলেছিল। বাংলাদেশ মনে করে, যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি দুই দিনে যেমন শেষ হতে পারে, তেমনি তা করতে বেশ সময়ও লাগতে পারে। কাজেই সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসওপি চূড়ান্ত করা প্রায় অসম্ভব। দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বুধবারের আলোচনায় অবৈধ কত বাংলাদেশি আছে, তা নিয়ে কোনো তালিকা ইইউ দিয়েছে কি না, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনো তালিকা দেওয়া হয়নি। তবে এ পর্যন্ত শুধু অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের সময় আট হাজার লোককে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করেছে ইইউ প্রতিনিধিদল।
বাংলাদেশের এক কূটনীতিক বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রাসেলসে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে ইইউর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়–বিষয়ক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গানার উইগান্ডের আলোচনায়ও অবৈধ লোকজনকে ফেরানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। ওই আলোচনায় ইইউ প্রথমে ২৪ হাজার অবৈধ বাংলাদেশির কথা তুললে পররাষ্ট্রসচিব কোন দেশে কতজন আছে, সেটির উল্লেখ করে একটি তালিকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর ওই বৈঠকেই অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা আড়াই হাজার বলা হয়। বাংলাদেশ আবার তালিকা দেওয়ার কথা বললে, অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশে আটক ২১৪ জনের কথা বলে ইউরোপ।
অবশ্য ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশিকে অবৈধভাবে আটকের সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা মনে করেন, সিরিয়ার শরণার্থী-সংকটকে পুঁজি করে ইউরোপে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক চাপ আছে। তাই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিভিন্ন দেশের অবৈধ লোকজনকে ইউরোপ থেকে বের করে দিতে ইইউকে চাপে রেখেছে।
শ্রম অধিকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এক কূটনীতিক বলেন, শ্রমিক অধিকার, বিশেষ করে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন চালুসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে বেশ চাপ দিয়েছে ইইউ। এ জন্য বুধবার আলাদা করে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ বলেছে, জেনেভায় শেষ হওয়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সম্মেলনে বাংলাদেশ নভেম্বরের মধ্যে বিষয়গুলো সমাধানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করেছে। সে অনুযায়ী ৩১ আগস্টের মধ্যে কর্মপরিকল্পনার খসড়া দেওয়া হবে।
শ্রমিক অধিকারের বিষয়টিতে এক বছর ধরে বাংলাদেশকে বারবার বলে আসছে ইইউ। বিশেষ করে গত ডিসেম্বরে আশুলিয়ায় শ্রমিক নির্যাতনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বাংলাদেশকে সংগঠিত হওয়ার মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি শ্রমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় ইইউ দূতাবাসের সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা জিল্লুল হাই রাজী গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের বাজারে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক যে বাণিজ্য-সুবিধা (জিএসপি) পায়, সেটি একেবারে আলাদাভাবে বিবেচনা করে ইইউ। তাই আইএলওতে বাংলাদেশ কী অঙ্গীকার করেছে, সেটিকে এখানে বিবেচনায় নিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে ইউরোপে জিএসপি অব্যাহত রাখার স্বার্থে শ্রমিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদ মেনেই বাংলাদেশকে সময়সীমা ধরে কাজ করতে হবে।