ফরহাদ মজহারের ঘটনায় নতুন মাত্রা

Slider জাতীয়

73973_f1আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক পরিষ্কার করে বলেছেন, প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য, ভিডিও ফুটেজ এবং কলরেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফরহাদ মজহার অপহৃত হননি। উনি স্বেচ্ছায় খুলনা গিয়েছিলেন। তবে তিনি ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে না যাত্রীবাহী বাসে করে খুলনা গিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। সরকারকে বিব্রত করা এবং অপহরণের কথা বলে তার পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক নারীকে দেয়ার জন্য তিনি এই ঘটনা সাজিয়েছেন।
গতকাল ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি এসব কথা বলেন।
এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে ফরহাদ মজহারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার অপহরণ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বলেছেন, তারা আমার চোখ বেঁধে ফেলেছিল। তারপর তাদের হাঁটু দিয়ে আমাকে ফ্লোরের ওপর চেপে ধরে রেখেছিল। সত্য প্রকাশ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ফরহাদ মজহার বলেন, আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা প্রকাশ করতে আমি মোটেও ভীত নই।
ফরহাদ মজহার গত ৩রা জুলাই ভোরে ঢাকার শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। পুলিশ মোবাইলফোন ট্র্যাক করে অনুসন্ধান শুরুর পর সেই রাতেই যশোরে হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে ফরহাদ মজহারকে পাওয়া যায়।
ফরহাদ মজহার অপহৃত হননি, স্বেচ্ছায় গেছেন: আইজিপি
সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বলেন, ফরহাদ মজহার দেশে একজন পরিচিত সিনিয়র বিশিষ্ট নাগরিক। তিনি অপহৃত হয়েছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে এসে দাবি করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে একটি কুচক্রী মহল দেশে এবং বিদেশে অপপ্রচার চালিয়েছে। কেউ বলেছে সরকার এটা করেছে, কেউ বলেছে পার্শ্ববর্তী একটি  দেশের গোয়েন্দা সংস্থা করেছে, কেউ  কেউ আবার প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে কথা বলেছেন। এইসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো মনগড়া কথা। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এমন বক্তব্য দিয়ে দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এই দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে জনগণের মাঝে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদেরকে অনেকেই বলছেন যে, বিষয়টি ক্লিয়ার করার জন্য। কিন্তু, পুলিশ সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কোনো কিছু বলে না। এ জন্য আমরা সময় নিয়ে তদন্ত করেছি।
তিনি আরো বলেন, গত ৩রা জুলাই ফরহাদ মজহারের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় একটি অপহরণ মামলা করা হয়। ভোর ৫টা ২৯ মিনিটে তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। তবে পরিবারের লোকজন রহস্যজনকভাবে তার অপহরণের কথা পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে জানায়নি। এই সংবাদ পাওয়ার পর পুলিশের সকল  গোয়েন্দা সংস্থা তাকে উদ্ধারের জন্য  চেষ্টা চালাতে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি ও মোবাইল ট্রাকিং করে জানা যায় যে, ফরহাদ মজহার আরিচাঘাট পার হয়ে গেছেন। আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে, তাকে একটি মাইক্রোবাসে অপহরণ করা হয়েছে। তাই আরিচার পরে সকল চেকপোস্টে মাইক্রোবাস থামিয়ে থামিয়ে তল্লাশি করা হয়েছিল। আমরা কমন মাইক্রোবাসগুলো তল্লাশি করেছি।
তিনি আরো বলেন, পরে মোবাইল ট্রাকিং করে জানা যায় ফরহাদ মজহার খুলনার অভয়নগরে রয়েছেন। সেখান থেকে হানিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। উনি মামলার একজন ভিকটিম। তিনি আদালতে তার বক্তব্য দিয়েছেন। কিছু বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবী অভিযোগ করেছেন যে, ফরহাদ মজহারকে আইনজীবীর পরামর্শ না করতে দিয়ে তাকে পুলিশ সরাসরি আদালতে নিয়ে গেছেন। এটা তাদের মনগড়া ব্যাখ্যা। পুলিশ সম্পর্কে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য তারা এইসব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, পুলিশের জবানবন্দি এবং আদালতে ফরহাদ মজহার যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে গরমিল পাওয়া গেছে। তিনি পুলিশকে বলেছেন যে, তাকে ৫টা ২৯ মিনিটে অপহরণ করা হয়। তার চোখ বাঁধা ছিল। অপহরণকারীরা তাকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছেড়ে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দেখা যায় যে, তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে ১০ বার মোবাইলফোনে কথা বলেছেন। অন্য একটি নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েছেন। এরমধ্যে অন্য একজন নারীর সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। ওই নারীর সঙ্গে যেহেতু তিনি তখন কথা বলেছেন সেহেতু নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ তার বিষয়ে খোঁজ নেবে এটাই স্বাভাবিক একটা বিষয়। ওই নারীকে পুলিশ চট্টগ্রামে পায়। তিনিও আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই নারী ২০০৭ সালে ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে যোগদান করেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের দুজনের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্পর্কের সূত্র ধরে ওই নারীর একবার সমস্যা হয়েছিল। তখন তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। গত ২রা জুলাই ওই নারী ফরহাদ মজহারকে একই সমস্যার কথা বলেন। এতে ফরহাদ মজহার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। ঘটনার দিন ৩টা ৪০ মিনিটে ওই নারীকে ফরহাদ মজহার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একবার ১৩ হাজার পরে ২ হাজার টাকা পাঠান। ঘটনার দিনে ফরহাদ মজহারকে ওই নারী ফোন করে বলেন যে, আপনি নাকি অপহৃত হয়েছেন? ফরহাদ মজহার খুলনায় নিজেই হানিফ কাউন্টারে বাসের টিকিট কেটেছেন গফুর নামে। টিকিটে তিনি নিজের নম্বরও দিয়েছেন।
আইজিপি আরো বলেন, ঘটনার দিন ৪টা ২১ থেকে ৬টা ২৮ মিনিট পর্যন্ত খুলনা নিউমার্কেটের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় তাকে মার্কেটে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। ওইদিন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছেন, ‘মুক্তিপণের টাকা তোমার কাছে রেখে দাও। ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে যে, ডেলিভারি হয়ে গেছে’। এইসব বিষয় পুলিশের তদন্তে উঠে আসলে দেখা যায় যে, ফরহাদ মজহার পুলিশের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন এবং আদালতে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মধ্যে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অপহৃতের সময় তিনি টাকা পাঠিয়েছেন, কথা বলেছেন, এসএমএস করেছেন এবং ঘোরাঘুরি করেছেন। ঘটনার এইসব চিত্র উঠে আসলে একজন ব্যক্তি অপহৃত হয়েছে তা কি বলা যায়? ঘটনার দিনই সরকারবিরোধী মতের একজন বুদ্ধিজীবী ডা. জাফরুল্লাহ বলে দিলেন যে, এটা পার্শ্ববর্তী দেশের এক গোয়েন্দা সংস্থা করেছে। এটা শেখ হাসিনা জানেন। এরমধ্যে লন্ডনে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের জন্য একটি মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছিল। ফরহাদ মজহারের মেয়ে আবার তার বাবাকে উদ্ধারের জন্য ১০ জন মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের কাছে চিঠি দিয়েছেন বলে শোনা গেছে। আমরা খুব স্বচ্ছতা নিয়ে বিষয়টি তদন্ত করেছি। একজন সিনিয়র বিশিষ্ট নাগরিক অপহৃত হয়েছে এমন সংবাদ শোনার পর তাকে উদ্ধারের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তদন্তে এইসব বিষয় উঠে এসেছে। সত্য সত্যই। মিথ্যা বললে আইনের শাসন ও নৈতিকতা থাকে না। ফরহাদ মজহারের বিষয়টি নাটক কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি তেমনই মনে হয়েছে।
ফরহাদ মজহার যদি মিথ্যাচার করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে পুলিশ কি ব্যবস্থা নেবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিনি যদি তার বিষয়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ করেন তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। আর যদি তিনি নমনীয় হোন তাহলে অন্যরকম পর্যালোচনা করে দেখা হবে। পরিবারের সদস্যরা বলছেন তিনি যখন বাসা থেকে বের হোন তখন তার কাছে কোনো ব্যাগ ছিল না এমন বিষয়ে আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, তিনি ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতেই বলেছেন তার কাছে একটি ব্যাগ ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বলেন,  রোজার মাসে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু, পুলিশের সতর্কতার কারণে ওই হামলা ঠেকানো গেছে। গত ৫ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১৪টি জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালিয়েছে। এতে ৫৭ জন নিহত হয়েছে। ৩২ জন আহত হয়েছে। এসময় আমরা ১০৪ জনকে উদ্ধার করেছি। জনগণের সহযোগিতা নিয়ে এইসব অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন  শেষে ফরহাদ মজহারের অপহরণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ভিডিও প্রেজেন্টেশন করে সাংবাদিকদের দেখানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোখলেসুর রহমান, ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিআইজি (অপারেশন) ব্যারিস্টার মাহাবুবুর রহমান, ডিআইজি (মিডিয়া) মো. মহসিন হোসেন, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন ও তেজগাঁও জোনের পুলিশের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার প্রমুখ।
গার্ডিয়ানকে ফরহাদ মজহার
আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা প্রকাশ করতে আমি মোটেও ভীত নই
অবশেষে মুখ খুলেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। তার ‘অপহরণ’ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। বলেছেন, কিভাবে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। ফরহাদ মজহার বলেছেন, এখনো তিনি প্রচণ্ড রকম মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। সুস্থ হতে তার অনেকটা সময় লাগবে। তার ভাষায়, তবে আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা প্রকাশ করতে আমি মোটেও ভীত নই। জোরপূর্বক নিখোঁজের পর যেসব মানুষ জীবিত ফিরে আসেন তারা পরে রহস্যজনক কারণে নীরবতা অবলম্বন করেন। যখন আমি কাজে ফিরবো তখন এ ইস্যুতে কাজ শুরু করবো। জোর করে এমন গুমের সংস্কৃতি আমাদেরকে বন্ধ করতে হবে।
বুধবার হাসপাতালের বিছানা থেকে ফরহাদ মজহার এ সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারটি নেন গার্ডিয়ানের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক করসপন্ডেন্ট মাইকেল সাফি। গার্ডিয়ান ফরহাদ মজহারের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের একজন সমালোচক হিসেবে। গার্ডিয়ান লিখেছে, অপহরণের পর ঢাকায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে দেয়া এটিই তার প্রথম সাক্ষাৎকার। তিনি এর আগে দেশের বা বিদেশি কোনো মিডিয়াকে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অপহরণকারীরা খুব কর্কশ ভাষা ব্যবহার করেছে। আমার মোবাইলফোন নিয়ে গিয়েছিল। আমার চোখ বেঁধে ফেলেছিল। তারপর তাদের হাঁটু দিয়ে আমাকে মিনিবাসের ফ্লোরের ওপর চেপে ধরে রেখেছিল।
বুধবার ফরহাদ মজহার বলেছেন, গত সপ্তাহে সকাল প্রায় ৫টার দিকে তার বাসার কাছের রাস্তা থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। তারা কারা তা তিনি নিশ্চিত নন। তার ভাষায়, ওইদিন সকালে আমার চোখে সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমি ওষুধ কেনার জন্য বাসা থেকে বের হই। অকস্মাৎ তিনজন মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে একটি সাদা মিনিবাসে তুলে নেয়। তিনি বলেন, এ সময় তিনি পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করতে সক্ষম হন এবং স্ত্রীকে ফোন করেন। ফরহাদ মজহার বলেন, (আমার স্ত্রীকে দেয়া) ওই ফোনকলটি ছিল একটি শর্ট কল। আমি তাকে শুধু বলতে পেরেছি, তারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাকে হত্যা করবে। বিষয়টি অপহরণকারীরা টের পাওয়ার আগে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি সামান্য সময়।
তিনি বলেছেন, অপহরণকারীরা তার চোখ বেঁধে ফেলে এবং তার মোবাইলফোনটি নিয়ে নেয়। তিনি যদি তার স্ত্রীকে আবার ফোন করেন, তিনি কোথায় আছেন পুলিশ তা ট্র্যাক করতে পারবে- এটা মনে করে তিনি তাদের মুক্তিপণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। ‘এরপরই তারা আমাকে ফোনটি দিয়ে দেয়। এ নিয়ে আমি কয়েক বার আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি’।
‘বাসটি কয়েক ঘণ্টা চলতে থাকে। এ সময়ে তারা আমাকে নানাভাবে নির্যাতন করে। মাঝে মধ্যেই আমার প্রতি আজেবাজে ভাষা ছুড়ে দিতে থাকে। তারা আমাকে থাপ্পড় দেয়। প্রায় ১০ বা ১২ ঘণ্টা পরে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে। এ সময় তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়। একটি নির্জন স্থানে নামিয়ে দেয় আমাকে। তখন কিছুটা অন্ধকার হয়ে এসেছে। এরপর তারা আমাকে একটি বাসের টিকিট ধরিয়ে দেয়। আমাকে বলে ওই বাসে করে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরে যেতে। তখন আমি কিছুটা পথ হেঁটে আসি। খুলনায় একটি মার্কেটে পৌঁছি। রাত ৯টা ১৫ মিনিটে বাসটিতে ওঠার আগে সেখান থেকে কিছু খাবার কিনি। আমাকে যখন জিম্মি রাখা হয়েছিল তখন আমি আমার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। মাইক্রোবাসটি ঢাকা ছাড়ার পর আমার এসব মোবাইল কলের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ আমার অবস্থান নির্ণয় করতে পারতো। এভাবেই আমাকে পরে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে আমি বিস্মিত, মাইক্রোবাসটি খুলনায় পৌঁছানোর আগে কেন পুলিশ মাইক্রোবাসটি ইন্টারসেপ্ট করতে পারলো না।
ফরহাদ মজহার আরো বলেছেন, তাকে অপহরণের জন্য প্রকৃতপক্ষে কারা দায়ী সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তার ভাষায়, আমার অপহরণকারীরা ছিল সাদা পোশাকে (প্লেন ক্লোথ)। তারা কারা ছিল বা কোন গ্রুপের ছিল তা আমি জানি না। ফরহাদ মজহার বলেছেন, তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সোচ্চার থাকবেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন নেতাকর্মী ও বিরোধী দলীয় নেতাদের অপহরণের যে ধারা চলছে তারই সর্বশেষ শিকার তিনি।
ফরহাদ মজহারের নিখোঁজের খবর যখন রহস্যময় হয়ে ওঠে তখন পুলিশ ঘোষণা করে, তিনি ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর খুলনার কাছে একটি বাস থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি গত এক সপ্তাহ পুলিশি প্রহরায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর হিসাব মতে, গত তিন বছরে বাংলাদেশে গুম হয়েছেন প্রায় ২২৩ জন মানুষ। তার মধ্যে ১৮ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সে বিষয়ে কেউ মুখ খোলেনি। ৩১ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এদের পরিবারসহ অন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলো ২০১৪ সালের জুলাই থেকে নীরবতা বজায় রাখছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অধিকার-এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো এ নিয়ে কথা বলতে শঙ্কিত। কারণ, তাদের ভয় পরিবারের অন্য সদস্যরাও একই পরিণতি ভোগ করতে পারেন।
ঢাকার পুলিশ ফরহাদ মজহারের মামলাটি তদন্ত করছে। তবে কর্মকর্তারা স্থানীয় মিডিয়াকে বলেছেন, ফরহাদ মজহারের দেয়া তথ্য নিয়ে তারা সন্দিহান। একজন কর্মকর্তা বুধবার ডেইলি স্টারকে বলেছেন, তিনি যে মাইক্রোবাসে করে খুলনা গিয়েছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।
গত সপ্তাহে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাতে অভিযোগ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার গোপনে আটক করে রেখেছে কয়েক শ’ মানুষকে। এর বেশির ভাগই মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, যারা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, অল্প কিছু মামলার তদন্ত করা হয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের লোকজন অবৈধ এসব আটকের জন্য দায়ী এমন অভিযোগ আমলে নেয় না পুলিশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, তারা যাদেরকে আটক করেন তা বৈধভাবে, আইন অনুযায়ী। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রচারণা চালাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি এএফপিকে বলেছেন, তারা বাংলাদেশে একটি নেতিবাচক প্রচারণা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, বাস্তবতার সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *