‘বঙ্গবন্ধুর ছবি নামাতে বলেছিলেন এরশাদ’

Slider জাতীয়

70197_rsad

 

 

 

 

 

 

ঢাকা: দিল্লির দূতাবাসে প্রায় সবাই ছিলেন শেখ মুজিবের আস্থাভাজন বা অনুগত। কর্নেল আবুল মনজুর (পরে মেজর জেনারেল) ছিলেন মিলিটারি অ্যাটাশে। ওই সময় কর্নেল এরশাদ দিল্লিতে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের (এনডিসি) প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। হাইকমিশনে তৃতীয় সচিবের দায়িত্বে ছিলেন মো. কামালউদ্দিন। তিনি ওই সময়ের একটা বিবরণ দিয়েছেন:

১৫ই আগস্ট ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। প্রথা অনুযায়ী সকালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লালকেল্লা থেকে ভাষণ দিচ্ছেন। শ্রোতাদের মধ্যে কূটনীতিকদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় বসে আছি। হঠাৎ কেউ একজন পেছন থেকে ঘাড়ে হাত দিয়ে আমাকে কিছু একটা বলতে চাইলো। ব্যাপারটা কূটনীতিকদের জন্য শোভন না। আমি ঘুরে তাকাতেই দেখলাম ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার একজন কূটনীতিক। বললেন, ‘তুমি কি জানো, তোমার দেশে কী ঘটেছে। তুমি যে এখানে বসে আছো?’। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘জানি না তো!’ সে আমাকে বললো, তুমি মিশনে যাও, রেডিও শোনো।’ সামনের দিকে আমাদের হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। মিশনে ফিরে এসে দেখি কর্নেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওদের কলেজ আমাদের দূতাবাসের পায়ে হাঁটা দূরত্বে। আমি তখন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তিনি আমাকে বললেন, আপনি কি হাইকমিশনের লোক?
-হ্যাঁ, আমি থার্ড সেক্রেটারি।
-ওই ছবিটা কেন এখানে আছে?
-কোন্‌ ছবিটা?
-ওই যে, ওই যে শেখ মুজিবের ছবি। ওইটা নামান।
-আপনার কথায় তো এটা নামানো সম্ভব না। আমাদের কাছে যদি নির্দেশ আসে, তাহলে নামাবো।
-বাহ্‌ আপনি তো একটু অন্যভাবে কথা বলেন।
লেখক ও গবেষক, মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘রক্তাক্ত আগস্ট’ শীর্ষক নিবন্ধে এসব কথা লিখেছেন। নিবন্ধটি প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে, লেখাটি আওয়ামী লীগের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইয়ের তৃতীয় পর্বের একটি অধ্যায়ের অংশবিশেষ।
এই লেখায় কামাল উদ্দিনের আরো বয়ান পাওয়া যায়, ‘ছবি আমি নামাইনি। দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জার্মানি থেকে দিল্লি বিমানবন্দরে এলেন। আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রটোকল অফিসার। তাকে হাইকমিশনারের বাসায় নিয়ে গেলাম। তারা দুজন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। কামাল হোসেন একদিন হাইকমিশনারের বাসায় ছিলেন। পরে লন্ডন চলে যান।
মহিউদ্দিন আহমদ তার নিবন্ধে আরো লিখেছেন, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে ইন্দিরা গান্ধী বিচলিত হয়েছিলেন, ইন্দিরার বন্ধু ও জীবনীকার পপুল জয়াকারের লেখায় বিষয়টি উঠে এসেছে। জয়াকারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধান এন কাও বলেছিলেন, মুজিবকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালেই এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের গোপন তৎপরতার খবর তার কাছে ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি ইন্দিরাকে জানিয়েছিলেন এবং ইন্দিরা তাকে এ নিয়ে কথা বলার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। কাও এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা বাগানে হাঁটছিলাম। আমি মুজিবকে বললাম, আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যে উদ্বেগ ছিল না। বললেন, ‘আমার কিছুই হবে না। ওরা তো আমারই লোক।’ আমি তাকে আমাদের পাওয়া সুনির্দিষ্ট তথ্যের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলাম।’

পঁচাত্তরের মার্চে কাও জানতে পারেন যে, বাংলাদেশের গোলন্দাজ বাহিনীতে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইন্দিরা সঙ্গে সঙ্গেই মুজিবকে তা জানিয়েছিলেন। ‘কিন্তু মুজিব এটা বিশ্বাস করেননি। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের জাতির জনক; তার লোকেরা তাকে খুন করতেই পারে না।’ চুয়াত্তরে এমন খবরও ছিল যে, বাংলাদেশের বাইরে থেকেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ১৫ই আগস্টের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে জয়াকার বলেন:
‘আমি ১৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় ইন্দিরার বাসায় গিয়েছিলাম। দেখলাম তিনি ভয়ে আচ্ছন্ন। নিজেকে নিরাপদ মনে করার চিন্তাটা একেবারে তলানিতে পৌঁছে গেছে। লালকেল্লা যাওয়ার ঠিক আগে তিনি হত্যাকাণ্ডের খবরটি শুনেছিলেন। সযত্নে তৈরি করা ভাষণটি তিনি দিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেয়ার কথা তার মনে হয়নি।

তিনি আমাকে বলেছিলেন, মুজিব হত্যা হলো ষড়যন্ত্রের প্রথম অধ্যায়, যা গোটা উপমহাদেশকে প্রভাবিত করবে। তিনি নিশ্চিত যে, তিনিই হবেন পরবর্তী লক্ষ্য। মুজিবের ছোট ছেলে খুন হওয়ার খবরটা তার সব চিন্তা এলোমেলো করে দিয়েছিল। তিনি ভয় পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি গোয়েন্দা রিপোর্টকে গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু এটা উপেক্ষা করা আর ঠিক হবে না।’ তিনি সব ব্যাপারেই সন্দেহপ্রবণ ছিলেন এবং সবাইকে সন্দেহ করতে শুরু করলেন। ছায়ার মধ্যেও তিনি শত্রু দেখতে পান। আমাকে বললেন, ‘কাকে বিশ্বাস করবো? রাহুল (ইন্দিরার ছেলে রাজীব গান্ধীর পুত্র) মুজিবের ছেলের প্রায় সমান বয়সী। কাল তার অবস্থাও এমন হতে পারে। তারা আমাকে এবং আমার পরিবারকে শেষ করে দেবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *