ভেঙে গেল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিকের স্বপ্ন!

Slider ফুলজান বিবির বাংলা শিক্ষা

3ee1361043b33a127224ebdac12ab02b-593111823cb92

ঢাকা; তাহলে শঙ্কাই সত্যি হলো। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হচ্ছে না আপাতত। এমন যে ঘটতে পারে সে কথা বিজ্ঞজনেরা আগেই বলেছিলেন। সন্দিহান ছিলেন সরকারের ঘুঁটিচালা কেরানি, ঠিকাদার আর সুবিধাভোগীদের কূটচাল নিয়ে। তাঁরা প্রজেক্ট আর ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত। ভুল পথে মহৎ উদ্দেশ্যও সফল হয় না। বিজ্ঞজনদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার স্তর কত দূর পর্যন্ত হবে, সে তর্ক শেষ হয়নি। পাকিস্তান আমলে এটা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। পঞ্চাশের দশকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়। তখন থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে তোলার সুপারিশ এসেছে। ১৯৫৯ সালের শরিফ কমিশন পরবর্তী ১৫ বছরে, অর্থাৎ সত্তর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ পাকিস্তানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করেছিল। ছাত্র গণ-আন্দোলনে শরিফ কমিশন বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের নূর খান কমিশন তো আলোর মুখই দেখেনি। ১৯৭৪ সালে কুদরত-এ-খুদা কমিশন ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টমে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে সে স্বপ্নও হিমাগারে যায়।
তারপর হরেক শিক্ষা কমিশন হয়েছে; কিন্তু সেসব কমিশনের সুপারিশ বিরোধিতার মুখে পড়ে, কিংবা ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে মৃত ঘোষিত হয়। সেদিক থেকে ২০১০ সালের কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনকে ভাগ্যবান বলতে হবে। এ কমিশন তেমন বিরোধিতার মুখে পড়েনি। আর এ সময়ের মধ্যে সরকারও বদলায়নি। সত্যি কথা বলতে কি, এই প্রথম কোনো শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একই সরকার সাত বছর সময় পেল এবং হয়তো আরও বছরখানেক পাবে। এই সাত বছরে শিক্ষামন্ত্রীও আছেন একজনই। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর ২০১৮ সাল নাগাদ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। সে হিসাবে হাতে এক বছর সময়ও নেই। কিন্তু সরকার অন্তত এ সত্যটা মেনে নিয়েছে যে এ রকম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের প্রস্তুতি নেই।
কত বছরের প্রাথমিক শিক্ষা যথাযথ, তা নিয়ে পৃথিবীতে মতভেদ আছে। ভারতে তা অনেক আগে থেকেই আট বছর মেয়াদি। অস্ট্রেলিয়ায়ও আট বছর। কিন্তু চীনে ছয় বছর। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিসর, জাপানেও তা–ই। ওদিকে পাকিস্তানে এখনো আমাদের মতোই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। আলজেরিয়া, ব্রাজিল, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেনে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর নবম শ্রেণি পর্যন্ত। এশীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করলে আমরা তেমন খারাপ অবস্থায় হয়তো নেই।
কিন্তু যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে অষ্টম শ্রেণির পাঠ সমাপনীকে আমরা নিম্ন-মাধ্যমিক না বলে এখন থেকে প্রাথমিক বলতে চাই, তাহলে কিন্তু কোনো সমস্যা নেই। শুধু সরকার একটা ঘোষণা দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কেননা, আমাদের দেশে সত্যি সত্যি প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত শুধু কেতাব ছাড়া আর কোনো পার্থক্য কখনো চিহ্নিত করা হয়নি।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহু বিচিত্র ধরনের। কোথাও নার্সারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক, কোথাও তৃতীয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক, কোথাও ষষ্ঠ থেকে ব্যাচেলর আবার কোথাও উচ্চমাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ানো হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (যার যার মতো) অনুমোদন দিয়ে নিজেদের সার্থক মনে করে। কাজেই কোথায় পড়ানো হয়, কে পড়ান, কী পড়ান—এসবই বাংলাদেশে অবান্তর প্রশ্ন।
তবে একটা ব্যবস্থা বেশ জবরদস্ত। প্রথম থেকে পঞ্চম প্রাথমিক, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত জুনিয়র, নবম-দশম মাধ্যমিক, একাদশ-দ্বাদশে উচ্চমাধ্যমিকের তকমা লাগানো আছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত তাবৎ বই রচনা, প্রকাশ ও বিনা মূল্যে বিতরণ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সট বুক বোর্ড (এনসিটিবি)। একাদশ-দ্বাদশের বই অনুমোদন দেয় এনসিটিবি। প্রাথমিকের পাঠদানের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক (হালে তা স্নাতক)-সহ সি-ইন-এড, মাধ্যমিক শিক্ষকের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতকসহ বিএড আর উচ্চমাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি (কোনো প্রশিক্ষণ আবশ্যকীয় শর্ত নয়)। কাজেই প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর, পাঁচ বছর বা দশ মেয়াদি কি না, এ প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর যতক্ষণ না আমরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সংজ্ঞা নির্ণয় করতে পারি। সে চেষ্টা এ বঙ্গে কখনো হয়েছে বলে শুনিনি। তবে কিছু শিক্ষাবিদ প্রশ্নটা তুলেছিলেন; কিন্তু কেরানিশাসিত বাংলায় কেরানিরা যা বুঝেছেন, বলেছেন জাতির কাঁধে তা-ই চাপানো হয়েছে।
স্বপ্ন তাঁরা যতই দেখান, শিক্ষায় হাড়কিপ্টেমিতে কেউ কারও চেয়ে কম যান না। এ খাতে বরাদ্দ কমাতে কমাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নামিয়ে আনা হয়েছে জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশে। এই বরাদ্দ নেপাল, ভুটানের চেয়েও কম। কাজেই যে বিপুল কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন ছিল, তার কিছুই করা হয়নি। অথচ শুধু সদিচ্ছা থাকলেই, অপচয় আর ব্যাংক খাতের লুটপাট রোধ করতে পারলেই শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব।
আমরা কাজের চেয়ে অকাজে ওস্তাদ। বিরোধিতাহীন এক শিক্ষানীতি পাস করাতে পেরে তাই সবজান্তারা আসল কাজে হাত না দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী আর জুনিয়র পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেশব্যাপী প্রতিবাদ, মানববন্ধন, আদালতে মোকদ্দমা ঠুকেও তা থেকে শিশু-কিশোরদের মুক্তি জুটল না। দেশে কোচিং বাণিজ্যের বন্যা বইল। অবুঝ শিশুরা গিনিপিগ হয়ে মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে, গোটা জাতি পঙ্গু হতে চলেছে।
শিক্ষার স্তর শুধু গেজেট প্রকাশ করা নয়; বরং মেধা, বয়স, রুচি, সামর্থ্য, জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা ও মানবিকতার বিকাশ, নৈতিক ও নিষ্ঠার অনুশীলন, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চর্চা। সেটা যদি তারা বুঝত, তাহলে আগে শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, গবেষকের সমন্বয়ে তারা ঠিক করত জাতীয় লক্ষ্য ও চাহিদাগুলো। কিন্তু এ দেশে তাবৎ কমিটি/কমিশন পদাধিকারীদের ক্লাব। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন দলীয় তকমাধারীরা। সেখানে ভিন্নমতের স্থান নেই। আর সেখানে চলে অবাধ লুটপাটের রাজত্ব।
গত কয়েক বছরে শিক্ষার এই দুর্দশা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, টক শো হয়েছে প্রচুর। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকারের ঘনিষ্ঠজনেরা কারও কথা গায়ে মাখেননি।
বহু ঢাকঢোল পেটানো জাতীয় শিক্ষানীতির বুনিয়াদ ধসে পড়েছে; শিক্ষার গোটা তাসের ঘর মাটিতে মিশে যেতে কতক্ষণ!
আমিরুল আলম খান: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *