সৌদি বাদশাহ ফয়সলকে যেভাবে হত্যা করা হয়

Slider সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাবিশ্ব

_95419360_faisal

 

 

 

 

 

 

১৯৭৫ সালের মার্চ মাস। সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সলকে হত্যা করা হয়েছে। খুব কাছে থেকে সরাসরি তাঁকে গুলি করেছিলেন তাঁরই ভাইপো। তখন তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন সৌদি আরবের সেসময়ের তেল মন্ত্রী শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি। তাঁর মেয়ে, লেখক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মেই ইয়ামানি বর্ণনা করেছেন এ ঘটনার কি প্রভাব পড়েছিল তাঁর বাবা এবং সৌদি আরবের ওপর।

সেই দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ২৫শে মার্চ। সৌদি বাদশাহ ফয়সাল রাজপ্রাসাদে এক কুয়েতি প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রাসাদে ঢুকেছে তাঁর নিজের এক ভাইপো। এই যুবরাজের নামও ফয়সাল।

বাদশাহ ফয়সল যখন তাঁর ভাগ্নেকে ঝুঁকে পড়ে চুমু খেয়ে অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই পরপর তিনটি গুলি করা হয় তাঁকে।

মেই ইয়ামানি এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারেন সেই দিনটির কথা।

“আমি সেই দিনটি কোনদিনই ভুলবো না। সেই কষ্ট আমাকে সইকে হয়েছে। আমি এখনো তা মনে করতে পারি। আমার বাবার যে বেদনা, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বাদশাহ ফয়সালের পাশে, যিনি ছিলেন তার সব কিছু– গুরু, বন্ধু, পথপ্রদর্শক। অথচ তাকে এত কাছে থেকে গুলি করে মারা হলো।”

মেই ইয়ামানির বাবা শেখ ইয়ামানি পনের বছর ধরে বাদশাহ ফয়সালের তেল মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন বাদশাহর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মন্ত্রীদের একজন। ঐ ঘটনার সময় তিনি বাদশাহ ফয়সালকে কোন একটা বিষয় ব্যাখ্যা করছিলেন।

ছবির কপিরাইট Rolls Press/Popperfoto
Image caption সৌদি বাদশাহ ফয়সাল

বাদশাহ ফয়সল ছিলেন তেল সমৃদ্ধ এই মরু রাজ্যের তৃতীয় বাদশাহ। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহর তৃতীয় সন্তান। ঘটনার পরপরই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে অল্প পরেই তিনি মারা যান।

ঐ একই দিনে ঘটনার কয়েক মাইল দূরে ১৮ বছর বয়সী মেই ইয়ামানি তখন অপেক্ষা করছেন তাঁর বাবার জন্য।

“আমি তখন আমার বাবার অ্যাপার্টমেন্টে বসে অপেক্ষা করছি, তার বই পুস্তকের মাঝে। তিনি বাসায় ঢুকলেন। তার চেহারায় গভীর বেদনার ছাপ, অদ্ভূত দৃষ্টি। তিনি হেঁটে সোজা খাবার ঘরে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি একটা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তিনি কোনরকমে একটা শব্দই বলতে পারলেন। মুসিবা। ভয়ংকর বিপদ।”

শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানিকে সবাই একজন শান্ত, ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ বলেই জানেন। বেশ নম্রভাষী তিনি। তাঁর এই আচরণ ছিল একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ।

সেদিন সকাল সাড়ে দশটায় কুয়েতের তেল মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল। তারা রাজপ্রাসাদে গিয়ে বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল।

“আমার বাবা ছিলেন তেলমন্ত্রী। তাই তিনি সেদিন বাদশাহ ফয়সালকে এ বিষয়ে আগে থেকে বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়েছিলেন। আর যে যুবরাজ এই কাজ করেছিল, বাদশাহর ভাইপো ছিলেন তিনি, ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে, তার নামও ছিল ফয়সল। কুয়েতের তেলমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে প্রতিনিধিদল বাদশাহর সঙ্গে দেখা করতে আসছিল, সেই প্রতিনিধিদলের ভেতরে ঢুকে পড়ে এই ফয়সাল। এরপর বাদশাহ ফয়সাল তাঁর ভাইপোকে আলিঙ্গন করার জন্য দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। আর তখন তাঁর ভাইপো পকেট থেকে একটা ছোট্ট পিস্তল বের করলেন। এরপর গুলি করছেন বাদশাহ ফয়সালকে। মাথা লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি। আমার বাবা তখন বাদশাহ ফয়সালের খুবই কাছে দাঁড়িয়ে।”

ছবির কপিরাইট Roger Jackson
Image caption শেখ জাকি ইয়ামানি। সৌদি আরবের তৎকালীন তেলমন্ত্রী।

সেসময় কোন কোন রিপোর্টে বলা হয়েছিল, হত্যাকারী নাকি পরে পুলিশকে জানিয়েছিল, শেখ জাকি ইয়ামানি বাদশাহ ফয়সালের এত কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন যে, সে ভেবেছিল, শেখ ইয়ামানিও গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।

ঘটনার পর বাদশাহ ফয়সালকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। তার সাথে ছিলেন শেখ ইয়ামানি।

“তিনি হাসপাতালে গেলেন। তারা বাদশাহ ফয়সালের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেন। এরপর সব কিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রিয়াদের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল, সব নিস্তব্ধ।”

বাদশাহ ফয়সাল সৌদি আরবের রাজসিংহাসনে বসেন ১৯৬৪ সালে। সেবছরের নভেম্বরে তিনি দায়িত্ব নিলেন তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে।

সৌদি আরব, যা আকারে প্রায় পশ্চিম ইউরোপের সমান, তখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ দেশ। বাদশাহ ফয়সালের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই দেশকে আধুনিকায়নের পথে তিনি কি নিতে পারবেন?

ছবির কপিরাইট Keystone-France
Image caption লন্ডন সফরে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে বাদশাহ ফয়সল

সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সাউদের বড় ছেলেদের একজন ছিলেন ফয়সল। আরব উপদ্বীপকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যে লড়াই চালান বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সাউদ, সেই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন ফয়সল। আবদুল আজিজ আল সাউদের পর বাদশাহ হন তাঁর বড় ছেলে। সেই সময় ফয়সাল প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে যখন ফয়সাল নিজেই বাদশাহ হলেন, ততদিনে তিনি একজন ধূর্ত এবং বিচক্ষণ রাজনীতিক এবং ধার্মিক মানুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি সৌদি আরবে সংস্কারও শুরু করলেন।

সৌদি আরবে যে বিপুল তেল সম্পদ আবিস্কৃত হয়েছে, সেই সম্পদ তিনি ব্যবহার করতে চাইলেন তার দেশের আধুনিকায়নের কাজে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আধুনিক বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হলেন তিনি।

কিন্তু বাদশাহ ফয়সালের এই সংস্কারের উদ্যোগকে খুব ভালো চোখে দেখেনি সৌদি সমাজের রক্ষণশীল অংশ। সৌদি রাজপরিবার নিজেই যে কট্টর ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী ছিল, তারা ছিল এতে ক্ষুব্ধ। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বাদশাহ ফয়সাল সৌদি আরবে প্রথম টেলিভিশন স্টেশন চালু করলেন। তখন সেই টেলিভিশন স্টেশনে সশস্ত্র হামলা হয়েছিল। এই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারই ভাই। আর এই ভাইয়ের ছেলেই পরে হত্যা করেন বাদশাহ ফয়সালকে।

বাদশাহ ফয়সাল সৌদি আরবে মেয়েদেরও স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন।

“বাদশাহ ফয়সাল অন্য অনেক দিক থেকেই আলাদা ছিলেন। সৌদি আরবে বহু বিবাহের ব্যাপক প্রচলন, কিন্তু বাদশাহ ফয়সালের একসঙ্গে একের বেশি স্ত্রী ছিল না। রাণী এরফাদ মেয়েদের জন্য স্কুল শিক্ষা চালু করলেন। আমি গর্বিত যে, আমি ছিলাম তার স্কুলের প্রথম নয়জন মেয়ের একজন। বাদশাহ ফয়সাল সৌদি আরবের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে রাজী করাতে পেরেছিলেন যে শিক্ষার মাধ্যমে মহিলাদের ভালো মায়ে পরিণত করতে হবে। তার এই কর্মসূচীর নাম ছিল, ‘দার-উল হানান’ অর্থাৎ স্নেহশীলতার স্কুল।”

মেই ইয়ামানির বাবা শেখ আহমেদ ইয়ামানি বাদশাহ ফয়সালের জন্য কাজ শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে। একদিক থেকে খুবই ব্যতিক্রমি ঘটনা ছিল সেটি। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের কেউ নন, একজন সাধারণ মানুষ। তবে তিনি ছিলেন খুবই উচ্চশিক্ষিত, পেশায় আইনজীবি।

শেখ ইয়ামানির লেখা কিছু নিবন্ধ বাদশাহ ফয়সলের নজরে পড়ে, তিনি সেগুলো পড়েছিলেন।

ছবির কপিরাইট Keystone
Image caption সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদুল রহমান ইরিয়ানি এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের।

“আমার বাবা আইন প্র্যাকটিস করার জন্য প্রথম অফিস খুললেন। এরপর তিনি এমন একটি নিবন্ধ লিখলেন, যা ছিল খুবই উস্কানিমূলক। এতে তিনি গণতন্ত্র এবং সুশাসনের দাবি জানালেন। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল আবু মেই নামে। অর্থাৎ মেই নামের এক মেয়ের বাবা। কারণ আমিই ছিলাম আমার বাবার প্রথম সন্তান। ফয়সাল তখন যুবরাজ। তিনি জানতে চাইলেন, কে এই লোক। কারণ তিনি আসলে তখন একজন আইন উপদেষ্টা খুঁজছিলেন।”

বাদশাহ ফয়সাল পরে শেখ ইয়ামানিকে তাঁর তেলমন্ত্রী নিয়োগ করলেন। এরপর বাদশাহ ফয়সাল এবং শেখ ইয়ামানি মিলে এমন এক নীতি তৈরি করলেন, যা প্রথমবারের মতো, সৌদি আরবকে তার বিপুল তেল সম্পদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিল। আরব বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি আরবকে এক নতুন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এনে দিল এটি।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের এই তেল সম্পদকে প্রথম একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সৌদি আরব। ততদিনে সৌদি আরব বিশ্বের এক নম্বর তেল রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছেন। ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমা দেশগুলোতে তেল রফতানি বন্ধের আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দিল। বিশ্বে রাতারাতি তেলের দাম বেড়ে গেল বহুগুণ। সৌদি তেলমন্ত্রী শেখ ইয়ামানিকেই তখন পাঠানো হলো বাকী বিশ্বকে বার্তা পাঠাতে।

শেখ ইয়ামানি তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইসরায়েল সব আরব এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করলে তেলের সরবরাহ বাড়ানো হবে না।

“আমরা যা চাই, তা হলো সব অধিকৃত আরব এলাকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হোক। এরপর আপনারা আগের মতোই আবার তেলের সরবরাহ পাবেন, যেমনটা ছিল ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে।”

একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তখন শেখ ইয়ামানিকে প্রশ্ন করেছিলেন, তেলের মূ্ল্য যে এত বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, এর ফলে কি বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যায়নি, বিশেষ করে বিশ্বের তেল উৎপাদনকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে শিল্পোন্নত উন্নত দেশগুলোর সম্পর্ক?

শেখ ইয়ামানির উত্তর ছিল, অবশ্যই, এই সম্পর্ক বদলে যাবে।

সম্পর্ক সত্যিই বদলে গিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন বাদশাহ ফয়সলকে বছরের আলোচিত ব্যক্তিত্ব বলে ঘোষণা করে।

একজন ভাইপোর হাতেই কেন বাদশাহ ফয়সালকে জীবন দিতে হয়েছিল, সেই কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। পরিস্কার নয় সেসময়ের ঘটনাবলীর সঙ্গে এই হত্যাকান্ডের সম্পর্ক।

“বাদশাহ ফয়সালকে কেন হত্যা করা হয়েছিল তার প্রকৃত কারণ আমরা জানি না। আমরা শুধু এটা জানি যে, বাদশাহকে যিনি হত্যা করেছিলেন, সেই ভাইপো ছিলেন মানসিক বিকারগ্রস্থ। তখন আমার বয়স ১৮ বছর। ঐ বয়সে আমি আমার বাবার বেদনা বুঝতে পেরেছিলাম। আমি এখনো তা মনে করতে পারি।”

এই ঘটনার পর আরও ১১ বছর শেখ ইয়ামানি সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী ছিলেন। মেই ইয়ামানি পরে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি পরে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিও করেছেন। সৌদি আরবের প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত নারী তিনি। সৌদি এবং আরব পরিচিতি নিয়ে তিনি বইও লিখেছেন। তিনি থাকেন লন্ডনে।

সূত্র ; বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *