প্রাসাদ নয়, ঝুপড়িতে থাকেন প্রেসিডেন্ট!

বিচিত্র

Jose Mujicaঢাকা: একমাথা এলোমেলো ধূসর চুলের ঢেউ, কুতকুতে চোখ, কাঁচাপাকা পুরু গোঁফজোড়া, দশাসই চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। শহরতলির শেষ প্রান্তে চাষজমি ঘেরা টিনের চালওয়ালা এক চিলতে ভাঙাচোরা আস্তানায় দেখা করতে গেলে সশস্ত্র দেহরক্ষীর ঝাঁক নয়, স্বাগত জানায় তিন-পেয়ে দেশি কুকুর আর মুরগির পাল। চোখ ধাঁধানো লিম্যুজিন বা সালোঁ নয়, ঘোরাফেরার জন্য তার নিত্যসঙ্গী ২৫ বছরের পুরনো ভোক্সওয়াগান বিটল। বেতনের ৯০ শতাংশই তিনি দান করেন বিভিন্ন ত্রাণকাজে। তিনি হোসে মুজিকা, লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট।

২০০৫ সালে প্রভাবশালী কলোরাডো ও ন্যাশনাল পার্টির জোটকে হারিয়ে উরুগুয়ের ক্ষমতায় আসে বামপন্থী জোট ব্রড ফ্রন্ট। প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন তাবারে ভাসকুয়েজ। ২০০৯ সালে ফের নির্বাচনে জেতে ফ্রন্ট। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন হোসে মুজিকা। তবে দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবন যাপনের ধারা বদলাতে রাজি হননি তিনি। সেই কারণেই বিলাসবহুল আড়ম্বর ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়ি-গাড়ি-খামার নিয়েই দিব্যি আছেন মুজিকা, দেশবাসী যাকে আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’।

মুজিকার তুমুল জনপ্রিয়তার পিছনে রয়েছে তার ঠোঁটকাটা, আদর্শবাদী ভাবমূর্তি এবং সহজ-সরল জীবন-যাপন। তার অনুগামীদের মতে, এল পেপে মুখে যা বলেন, কাজেও তা করে দেখান। উল্টো দিকে, সমালোচকরা বলেন, মুজিকার আগাগোড়াই দেখনদারী। আদতে তিনি এক পাগলাটে, বাতিকগ্রস্ত বুড়ো যিনি বন্দুক ও বিপ্লব, দুটিই সরিয়ে রেখেছেন। নিন্দুকদের কথায় অবশ্য আদৌ আমল দেন না প্রেসিডেন্ট। স্পষ্টবক্তা হিসেবে বরাবরই বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন তিনি। ক্ষমতায় এসে একদিকে যেমন দেশে গাঁজার চাষ ও বিপণনকে বৈধতা দিয়েছেন, তেমনই গর্ভপাত এবং সমকামী বিবাহকেও আইনি অনুমোদন প্রদান করেছেন। আবার এই মুজিকাই জাতিসঙ্ঘের সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে সদস্যদের বলেন, ‘বিপুল অর্থব্যয়ে আয়োজিত বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করুন। ওখানে কাজের কাজ কিছুই হয় না।’

যৌবনে বাম চরমপন্থী গেরিলা নেতা হিসেবে উরুগুয়েতে ত্রাস সঞ্চার করেছিলেন মুজিকা। মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোয় প্রবল দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল তাকে। স্থানীয় এক বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে ওই বয়সেই রোজগার শুরু করতে হয় মুজিকাকে। এছাড়া বাড়ির পিছনে বয়ে যাওয়া খাঁড়ি থেকে অ্যারাম লিলি ফুল তুলে বিক্রি করেও পরিবারের খরচ জোগান তিনি। যুবা বয়সে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা এনরিকে এরোর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তিনি। কিন্তু স্বাধীন কিউবায় চে গুয়েগভারার সংস্পর্শে আসার পর তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার বদল ঘটে। পঞ্চাশের দশকের শেষে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি ও রুগ্ন অর্থনীতির চাপে মহাসঙ্কটে পড়ে উরুগুয়ে। এই সময় চে-র ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন মুজিকা ও তার সঙ্গীরা।

শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরুর কিংবদন্তী বিপ্লবী চরিত্র দ্বিতীয় টুপাক আমারুর নামানুকরণে তাদের হাতেই জন্ম নেয় গেরিলা বাহিনী ‘টুপামারো’। অত্যাচারীর নিধন ও দরিদ্রের পালন নীতিতে বিশ্বাসী টুপামারোদের জনপ্রিয়তা উরুগুয়ের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজে বাড়তে থাকে হু হু করে। ব্যাঙ্ক লুঠ করে সমাজের বিত্তশালীদের অবৈধ অর্থসঞ্চয় দরিদ্রদের উন্নয়নে ব্যয়, ধনী ব্যবসায়ীকে হত্যা করে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, দামী ক্যাসিনো দখল করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের টাকা পাঠানো ইত্যাদি কাজে হাত পাকিয়ে ফেলে তারা। কিন্তু ক্রমে দলীয় বিশৃঙ্খলার কারণে গতি হারায় বিপ্লব। ভাঙতে শুরু করে বিপ্লবীদের দলীয় সংহতি। একের পর এক অপহরণ ও ঠান্ডা মাথায় খুনের জেরে জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে টুপামারোরা। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে এক পানশালায় পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ের পর গ্রেপ্তার হন এল পেপে। তার পেটে মোট ৬টি গুলি ঢোকে।

গ্রেপ্তারের পর তার ঠাঁই হয় মন্টেভিডিও শহরের পান্টা ক্যারেটাস কারাগারে। সেখান থেকে দুবার পালিয়ে গিয়েও ১৯৭২ সালে ফের ধরা পড়েন মুজিকা। ১৯৭৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উরুগুয়ের মসনদে বসেন প্রেসিডেন্ট হুয়ান মারিয়া বোর্দাবেরি। গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে শুরু হয় একনায়কতন্ত্র। মুজিকা-সহ ৯ জন টুপামারো বিদ্রোহীকে পাঠানো হয় সামরিক কারাগারে। শর্ত দেয়া হয়, ফের বিদ্রোহের চেষ্টা করলেই প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। ১৯৮৪ সালে গণ অভ্যুত্থানের পর একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। দীর্ঘ ১১ বছর একরত্তি সেলে বন্দি জীবন কাটানোর পর ১৯৮৫ সালে মুক্তি পান মুজিকা। ৮০ ও ৯০-এর দশকে উরুগুয়ে শাসন করে কলরাডো পার্টি। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জয়ের কাছাকাছি এসেও হার মানে ব্রড ফ্রন্ট। তবে ৯৯ জন পার্লামেন্ট সদস্যের পার্লামেন্টে ঠাঁই হয় দুজন প্রাক্তন টুপামারো নেতার। এদেরই একজন হোসে মুজিকা। সেই সময় প্রতিদিন নিজের লড়েঝড়ে স্কুটার চেপেই পার্লামেন্টে যাতায়াত করতেন তিনি। সাধারণ পোষাকে চলতি ভাষায় অবিশ্রান্ত গালাগালিতে ভরপুর তার বক্তৃতা রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়।

২০০৯ সালের নির্বাচনে এই জনপ্রিয়তার শিখরে চড়েই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন মুজিকা। তবে তাতেও নিজেকে বদলাননি তিনি। একদা সতীর্থ বিপ্লবী লুসিয়া টোপোল্যানস্কির সঙ্গে ২০ বছর লিভ ইন সম্পর্কের পর ২০০৫ সালে বিয়ে করার ফুরসৎ পান এল পেপে। ফুলের বাগান ঘেরা শহরতলির তিন কামরার বাড়িতে কুকুর-বিড়াল-মুরগি আর ভেড়াদের নিয়ে সুখে সংসার পেতেছেন তারা। প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই সমবয়সী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। ৭৯-তে পৌঁছে অতীতের বিদ্রোহী সত্তা কী খানিক স্তিমিত?

প্রশ্ন শুনে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে মুজিকা সাফ জানিয়ে দেন, যুগের সঙ্গে সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে বটেই। তবে পরিবর্তনের খিদেটা অবিকল রয়ে গিয়েছে আজও। শুধু বাঁধনছাড়া আবেগের বদলে জায়গা করে নিয়েছে তীব্র বাস্তব বোধ। আর সেই উপলব্ধির উজান বেয়ে জীবনের প্রান্তে এসেও উরুগুয়ের মঙ্গলসাধনে সমান অনুপ্রাণিত প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *