কৃষকদের হাহাকার-আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে হাওরের আকাশ-বাতাস

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাদেশ সিলেট

 

IMG_20170425_012739

 

 

 

 

 

হাফিজুল ইসলাম লস্কর :: বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনাময় অথচ বিপন্ন এক জনপদের নাম ‘হাওর’। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তত ৪০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ ভূ-ভাগ ‘শস্য ও মৎস্যভান্ডার নামে পরিচিত। ষড়ঋতুর দেশ হলেও হাওর এলাকার ঋতুবৈচিত্র্য কিছুটা ব্যতিক্রম। হাওড়বাসীর কাছে ঋতু মাত্র দুটি। একটি বর্ষা, অন্যটি হেমন্ত। বর্ষার ছয়-সাত মাস অথৈ জলরাশির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয় হাওরের অধিবাসীদের। আর হেমন্তের পাঁচ-ছয় মাস তারা ব্যস্ত থাকেন কৃষি কাজ নিয়ে। এখানকার কৃষি মানেই বোরো ফসল।
দেশের এক-পঞ্চমাংশ ধান উৎপাদিত হয় হাওরাঞ্চলে। একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভর করেই সারা বছর বেঁচে থাকে হাওরের মানুষজন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বোরো চাষীদের সেই সোনালি স্বপ্নকে প্রায় প্রতিবছরই চুরমার করে দেয়। আর ফসল মার গেলে কৃষকদের হাহাকার-আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে হাওরের আকাশ-বাতাস। বদলে যায় হাওরের অর্থনৈতিক চালচিত্র। হাওরের ‘দুর্গম গিরি-কান্তার মরু’ ভেদ করে শহরাঞ্চলের ব্যস্ত ‘নাগরিক কানে’ এর অনেক খবরই ঠিকমতো পৌঁছে না। যুগ যুগ ধরে এটাই হাওরবাসীর করুণ নিয়তি।
এবারও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টির পানিতে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং অন্যান্য হাওরবেষ্টিত জেলার হাজার হাজার হেক্টর বোরো জমি আগাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি-না জানি না, হাওরে এবার বন্যা হয়েছে অন্যান্যবারের তুলনায় অনেক আগেভাগে। মার্চের শেষ সপ্তাহে যখন প্রচ- খরতাপ বয়ে যাবার কথা, ঠিক তখনই উজান থেকে আসতে শুরু করে পাহাড়ি ঢল। সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। এ কারণে এপ্রিলের দু-তিন তারিখের মধ্যেই তলিয়ে যায় অসংখ্য ফসলি হাওর। অন্যান্য বছর আগাম বন্যার সময় কাঁচা ধান কেটে কিছু ‘খোরাকি’ বা গো-খাদ্য সংগ্রহের যে চেষ্টা চলত, এবার তাও পারেননি কৃষকরা।
কারণ, সবেমাত্র জমিতে ধানের ফুল বেরোচ্ছিল (কৃষিবিদরা যাকে বলেন ফ্লাওয়ারিং স্টেজ)। অর্থাৎ গোটা হাওরাঞ্চলে যখন হাতছানি দিচ্ছিল সবুজের সমারোহ, বাতাসে দোল খাচ্ছিল কচি ধানের শীষ, ঠিক তখনই ধেয়ে আসে সর্বনাশা ঢল।
এদিকে ফসল রক্ষায় প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামও কম করেননি হাওরের মানুষ। ঢলের পানি দেখেই সংঘবদ্ধ হয়েছেন তারা। যার জমি নেই তিনিও ছুটে গেছেন হাওরে। সারাদিন, এমনকি রাতেও হ্যাজাক লাইট বা জেনারেটরের আলোতে স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটেছেন হাজার হাজার মানুষ। উদ্দেশ্য হাওর রক্ষা বাঁধ উঁচু করা। নদ-নদীতে পানি যত বেড়েছে, বাঁধও তত উঁচু করার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে শেষ রক্ষার অভিযান। ধনু, কংশ, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ঘোরাউৎরা, মগড়া, দাইরা, খৈসর, কালনিসহ বিভিন্ন নদী দিয়ে বয়ে আসা মেঘালয়ের পানির স্রোত নিমিষেই ভেঙ্গে দিয়েছে অসংখ্য বাঁধ। আবার কোন কোনটি সম্পূর্ণ তলিয়েও গেছে। এভাবেই পাহাড়ি ঢল ভেঙ্গে দিয়ে গেছে হাওরবাসীর স্বপ্ন। পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় খুব স্বল্প পরিসরেই উঠে আসছে হাওরের ফসল ডুবি বা কৃষকের সর্বনাশের খবর।
বলাবাহুল্য, হাওরাঞ্চলের আশিভাগ মানুষই একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। তাদের সারা বছরের খাদ্য, সন্তানের লেখাপড়া, ঘরে থাকা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে বা আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে, হাড়ভাঙা খাটুনির কারণে জীর্ণ শরীরের চিকিৎসা, বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য বসতবাড়ির ভিটেমাটি উঁচু করাসহ সবই নির্ভর করে একমাত্র বোরো ফসলের ওপর। তাই ফলন ভাল হলে কৃষক পরিবারগুলোতে আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু এবার তাদের সব স্বপ্ন-আকাঙ্খা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। বিকল্প আয়ের সুযোগ না থাকায় এখানকার কৃষকদের জমি চাষাবাদ করতে হয় ঋণের ওপর নির্ভর করে। ব্যাংক, এনজিও এবং মহাজন এই তিন উৎস থেকেই পুঁজি সংগ্রহ করেন তারা। ধান ঘরে তোলার পর তা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু ফসলডুবির কারণে এবার তাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাও শেষ হয়ে গেছে। ধনী-গরিব সব যেন একাকার হয়ে গেছে। মাথার ওপর ঋণের বোঝা, সহায়-সম্বল হারানো ব্যথা, আর শূন্য পকেটে সারা বছরের খাদ্য যোগাড় এবং সন্তানের পড়ালেখা চালানোর দুশ্চিন্তায় এখন প্রতিটি পরিবারে চলছে কান্না-আহাজারি। কাছে থেকে না দেখলে তা বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন হবে অনেকের কাছে।

IMG_20170401_225522

 

 

 

 

 

 

 

কিন্তু হাওরবাসীর এই করুণ পরিণতির কি কোন প্রতিকার নেই? হাওর উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ স্থানীয় পর্যায়ে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কি কোন দায়ই নেই? নির্বাচন এলেই হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দও হয় বাঁধ নির্মাণের জন্য। কিন্তু বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে তেমন কোন কাজেই আসে না। বরাবরই এ নিয়ে চলে শুভঙ্করের ফাঁকি। হয় ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়ম-দুর্নীতি। খোঁজ নিয়ে এর অনেক কারণও জানা গেছে। কিছু বিষয় খবরেও এসেছে। হাওরের বাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। কিন্তু প্রায় বছরই পাউবো উপযুক্ত সময়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে না। তারা ঠিকাদারদের যে সময়সীমা বেঁধে দেয় তাতেই সূত্রপাত ঘটে পুকুরচুরির। প্রায় সময়ই লক্ষ করা যায়, হাওরে পানি আসতে শুরু করলেও বাঁধগুলোতে মাটি কাটার কাজ শেষ হয় না। ফলে কৃষকদেরই বাঁধ রক্ষায় নামতে হয়। আর এমনটি করলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ঠিকাদার দু’পক্ষেরই পেট ভরে। বাঁধ পানির নিচে রেখে শতভাগ কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেয়া যায়। আবার যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সে দলের কর্মীরাই বাঁধ মেরামতের ঠিকাদারি পায়। অভিযোগ, ঠিকাদাররা বাঁধ মেরামতের কাজে কৃষকদের সঙ্গে কোনরূপ সমন্বয় করেন না।
তবে এটিও সত্য যে, বছর বছর মাটির বাঁধ দিয়ে হাওরের ফসল রক্ষা করা যাবে না। পাহাড়ী ঢল আসবেই। তাই স্থায়ী সমাধান হিসেবে মাটির বদলে ইট-কংক্রিটের শক্ত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি ঢলের পানি ধারণ করে রাখারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। হাওরাঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবহমান নদ-নদীগুলোর বেশিরভাগই আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। একই অবস্থা প্রায় ৬ হাজার ৩শ’টি বিল এবং অসংখ্য খাল, নালা ও ডোবারও। কোন কোনটির এখন আর অস্তিত্বই নেই। অথচ এক সময় প্রাকৃতিক জলাধারের পানি দিয়েই হাওরের সেচ চলত। সারাবছর চলত নৌ-যোগাযোগ। বলাবাহুল্য, এখন মাঘ-ফালগুনেই সেগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। আবার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য পাহাড়ি ঢলেই উপচে গিয়ে সৃষ্টি করে অকাল বন্যার। তাই প্রকৃতির এই জলাধারগুলো মুক্ত করে পানি ধারণ করে রাখার উপযোগী করতে হবে। নদীগুলোর গতিপথ ঠিক করে খনন করতে হবে। নদী খনন করলে খনন করা মাটি দিয়ে পাড়গুলোও উঁচু করা যাবে। এতে পাড়ের বাঁধ যেমন উঁচু হবে তেমনি নদীর পানি ধারণক্ষমতাও বাড়বে। তবে নদীর পাড় এবং বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণেরও বছরব্যাপী উদ্যোগ থাকতে হবে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ বা ‘ক্যাশ ফর ওয়ার্ক’ ধরনের কর্মসূচি চালু করে বাঁধগুলো উঁচু ও মেরামত করলে একদিকে যেমন বাঁধ রক্ষা হবে তেমনি দরিদ্র, দিনমজুর-কৃষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে। কোন কোন এলাকায় বাঁধ-কাম-রাস্তা নির্মাণ করে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনা সম্ভব। এছাড়া বাঁধের পাশে হিজল, করচ, বিন্না, ইকর প্রভৃতি পানিবান্ধব গাছ রোপণ করেও ভাঙন রোধ করা যেতে পারে। হাওরের পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করতে হবে সুইস গেট ও রেগুলেটর। হাওর উন্নয়ন বোর্ড বা পানি উন্নয়ন বোর্ড যারাই এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে তাদের কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে স্থানীয় কৃষকদেরও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে হাওরের কৃষক পরিবারগুলোতে এখন যে হাহাকার চলছে তা মোকাবেলায় হাওরাঞ্চলকে দ্রুত ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জরুরি পুনর্বাসন করতে হবে। পূর্ববর্তী সব ধরনের ঋণ মওকুফসহ নতুন করে ঋণ ও খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। আগামী ফসলের জন্য বরাদ্দ করতে হবে বিনামূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক। এছাড়া শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনতে হবে, যাতে অভাব-অনটনের কারণে কেউ ঝরে না পড়ে। এসব না করলে হাওরের হাহাকার এবার সহজে থামবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *