তাৎপর্যপূর্ণ সফরে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী

Slider ফুলজান বিবির বাংলা বাংলার মুখোমুখি সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

60530_pm1

 

কূটনৈতিক রিপোর্ট; প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। তবে প্রতিরক্ষা খাতে দু’টি পৃথক সমঝোতা স্মারকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ২০টি চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে জানিয়েছে দিল্লির বিদেশ মন্ত্রক।
গতকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে দিল্লিতে ব্রিফিং করেন বিদেশ মন্ত্রকের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ডেস্কের প্রধান, যুগ্ম সচিব শ্রিপ্রিয়া রঙ্গনাথান। সেখানে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে চলা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রাজ্যগুলোর মতামত নিয়ে যে কোনো চুক্তি সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা খাতে সমঝোতার বিষয়ে বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা  জানান, এ খাতে সহযোগিতা সংক্রান্ত দু’টি সমঝোতা স্মারক সই হবে, যার প্রথমটি হবে স্ট্র্যাকচার বা কাঠামো বিষয়ক। দ্বিতীয়টি হবে লাইন অব ক্রেডিট বা ঋণের আওতায় সাপ্লাই বা সরবরাহ বিষয়ক। কাঠামো বিষয়ক সমঝোতাটি আপাতত ৫ বছর মেয়াদি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো পক্ষের আপত্তি না থাকলে এর মেয়াদ অটো রিনিউওয়াল বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। আগামী শনিবার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের নেতৃত্বাধীন আনুষ্ঠানিক আলোচনা অর্থাৎ শীর্ষ বৈঠক শেষে ওই সব চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের আলোচনায় আগামীর পথ চলার স্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। ওই বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিও প্রকাশ করা হবে। তাৎপর্যপূর্ণ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মধ্যাহ্নে দিল্লি পৌঁছাবেন উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসেবে শেখ হাসিনা তার বর্তমান মেয়াদের প্রথম দ্বিপক্ষীয় ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর বিশেষ আতিথেয়তায় রাষ্ট্রপতি ভবনেই থাকবেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর এবারের দিল্লি সফর বিষয়ক গতকালের প্রতিবেদনে ‘এ ভিজিট উইথ আউট ওয়াটার’ বা ‘পানি ছাড়া একটি সফর’ বলে আখ্যায়িত করেছে এনডিটিভি। দিল্লির কর্মকর্তাদের বরাতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে প্রায় ২০ বছর ধরে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে আলোচনা চলছে বলেও উল্লেখ করা হয়। বার্তা সংস্থা পিটিআই’র বরাতে হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনসহ দিল্লি থেকে প্রকাশিত গতকালের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনেও তিস্তা সইয়ের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে।
দিনের শুরুতে ঢাকা ছেড়ে যাবেন প্রধানমন্ত্রী: এদিকে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে ঢাকার কর্মকর্তারা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় সফরে আজ দিনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাবেন। ভারতের ভারি শিল্প বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী নয়াদিল্লির পালাম এয়ারফোর্স স্টেশনে দুপুরে প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন। পররাষ্ট্র, আইন, পানি সম্পদ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ৪০ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন। পররাষ্ট্র সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের ডজন খানেক কর্মকর্তা সফরের অ্যাডভান্স টিম হিসেবে এরই মধ্যে দিল্লি পৌঁছেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা মনে করেন- বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন নতুন উচ্চতায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যকার সেই সুসম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। উভয়ের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের দ্বার উন্মোচিত হবে। সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেক হাসিনার একান্ত বৈঠক এবং আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, আলোচনার টেবিলে অনেক এজেন্ডা রয়েছে। সেখানে ভারতের সঙ্গে যে সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে তার মধ্যে প্রতিরক্ষা ছাড়াও বর্ডার হাট স্থাপন, তথ্য ও সমপ্রচার, বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ও মহাকাশ গবেষণা, ভূ-তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, ভারত কর্তৃক প্রদেয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি), কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্পর্কিত। শনিবার হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠক শেষে দিল্লিতে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বিরল-রাধিকাপুর রুটে মালামাল পরিবহনকারী রেল চলাচল, খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বাস ও রেল চলাচল এবং ত্রিপুরার পালটানা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করবেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও অংশ নিতে পারেন। ওই উদ্বোধন শেষে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী মিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করবেন। সফরকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যেসব সেনা শহীদ হন, তাদের মরণোত্তর সম্মাননা জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ৭ জন শহীদের নিকট আত্মীয়ের হাতে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক এবং সম্মাননাপত্র তুলে দেবেন। এই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। দিল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ-বৈঠক হবে। মমতা ব্যানার্জিও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। সফরে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন- দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সমপ্রসারণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, আন্তঃযোগাযোগ তথা কানেকটিভিটি, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, জনযোগাযোগ, পদ্মা (গঙ্গা) ব্যারেজ নির্মাণ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সুরক্ষা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদক চোরাচালান ও মানবসম্পদ রোধ প্রভৃতি অধিক গুরুত্ব পাবে। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী আজমীর শরীফ জিয়ারতে যাবেন। সফরের সমাপনীতে দিল্লিতে দুই দেশের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি বিজনেস ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা করবেন। সেখানে সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা অংশ নেবেন। ওই বিনজেস ইভেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশের চিত্র ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে তুলে ধরা ছাড়াও তাদের বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হবে। আগামী ১০ই  এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
তিস্তু চুক্তির সম্ভাবনা কম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা কম। তবে আজ থেকে শুরু হওয়া ওই সফরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ২৫টি চুক্তি সই হবে বলে বার্তা সংস্থা পিটিআই’র বরাতে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যমান সহযোগিতা আরো গভীর করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সফরে এবার মেজর ফেকাস বা বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতে। এর অংশ হিসেবে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ বা লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশে মিলিটারি হার্ডওয়্যার সাপ্লাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে দিল্লি। এছাড়া দুই দেশ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পরিবহন এবং জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়াবে। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তরফে এ চুক্তিতে আপত্তি থাকায় এবারের সফরে ভারত অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তিটি সইয়ে আশাবাদী নয়। জানা গেছে, মমতা ব্যানার্জিকে অন বোর্ডে না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তিটি সইয়ের বিষয়ে সামনে এগুতে পারবে না। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সফরের একেবারে শেষ সময়ে এসে মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য তিস্তার পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে, ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। ওই সময়ে পানির প্রবাহ ৫০০০ কিউসেক থেকে অস্থায়ীভাবে ১০০০ কিউসেকের নিচে চলে আসে। প্রতিবেদনের সমাপনী অংশে তিস্তা চুক্তি বিষয়ে অবগত বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে ফের বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী  হাসিনার এবারের সফরে এ চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *