অপারেশন হিট ব্যাক মৌলভীবাজারে ২ জঙ্গি আস্তানায় অভিযান গোলাগুলি, বিস্ফোরণ

Slider জাতীয় সিলেট

 

 59479_f1
মৌলভীবাজার;  সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানায় অভিযান সমাপ্তির পরের দিন পাশের জেলা মৌলভীবাজারে দিনভর জঙ্গিবিরোধী অভিযান হয়েছে। জেলা শহর ও সদর উপজেলার নাসিরপুর গ্রামের দুটি বাড়ি ঘিরে এ অভিযান শুরু হয় গতকাল ভোর থেকে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অভিযান চলছিল। এতে অংশ নেন বিশেষ বাহিনী সোয়াতের সদস্যরা। এছাড়া কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ ও জেলা পুলিশ এ অভিযানে অংশ নেয়। নাসিরপুরের বাড়িটি থেকে দিনভর গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বিকালে শুরু হওয়া মূল অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন হিট ব্যাক’। সিলেটে টানা পাঁচ দিন অভিযান চলার পর মৌলভীবাজারে জঙ্গিবিরোধী এ অভিযানে দিনভর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল জেলাজুড়ে। অভিযানের কারণে ওই বাড়ির আশেপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। গতকাল ভোররাত থেকে একযোগে পৌর এলাকার বড়হাট (৬ নং ওয়ার্ড) আবু শাহ মাজার সংলগ্ন একটি বাসায় ও সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসীর বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা দুটির সন্ধান পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু করে। নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে জঙ্গিরা একাধিক গ্রেনেড চার্জ করেছে বলে পুলিশ জানায়। দুপুর ২টা থেকে দুটি স্থানের আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় বলে নিশ্চিত করেন জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম। এদিকে বিকাল পৌনে পাঁচটায় পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াত ও গোয়েন্দা পুলিশের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের কয়েকটি গাড়ি, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি নাসিরপুর গ্রামের পাশের সড়কে অবস্থান নেয়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ওই বাড়ি থেকে থেমে থেমে গুলির শব্দ আসে। সাড়ে সাতটার পর গুলির শব্দ থেমে যায়। এদিকে সকাল থেকে নাসিরপুর গ্রামের আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে লন্ডন প্রবাসী সাইফুর রহমানের বাড়ি ঘিরে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাব, পিআইবিসহ আইনপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা যোগ দেন। স্থানীয়রা জানান, প্রবাসীর এই দুটি বাড়ি (শহর ও গ্রামের) তারই কেয়ারটেকার জুয়েলের কাছ থেকে একটি সংস্থার কর্মচারী পরিচয় দিয়ে গত দুই মাস আগে জনৈক বেলাল ও মাহফুজ ভাড়া নেয়। বেলাল থাকে শহরের বড়হাটের বাসায়। মাহফুজের সঙ্গে থাকে মহিলা-পুরুষসহ মোট ৮ জন। আর বেলালের সঙ্গে থাকেন মোট তিনজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন মঙ্গলবার রাত থেকে ঘটনাস্থলের আশেপাশে অবস্থান নেয়। ভোর ৬টার কাছাকাছি সময় স্থানীয় তিন ব্যক্তি খবর পেয়ে নাসিরপুরের বাড়িতে যান এবং দরজায় নক করেন। ভেতরের লোকজন দরজা ফাঁক করে পেছনে পুলিশ দেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই সময় শব্দ হয়। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি ভেতর থেকে গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। সকালে যাওয়া স্থানীয় তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন ছিলেন পার্শ্ববর্তী ফতেপুর গ্রামের আদিল (৫০)। তিনি জানান, তারপর থেকে থেমে থেমে শব্দ হতে থাকে। পুলিশ বাড়িটির চারদিক ঘিরে রাখে। নাসিরপুরের আনকার মিয়া চৌধুরী (৮০) জানান, ফজরের নামাজের পর থেকে গুলির শব্দ শোনা যায় সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। তারপর থেমে থেমে একটা দুটো করে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সন্দেহজনক এই দুই বাড়ি ও বাসার দরজা সব সময় বন্ধ থাকতো। তারা কারো সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলতো না। পুলিশ তাদের রহস্যজনক চলাফেরা দেখে সন্দেহ হলে অনুসন্ধান শুরু করে। প্রবাসে থাকা বাড়ির মালিকের প্রদান করা তথ্য ও আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পুলিশ বুধবার ভোরে তাদের খোঁজ নিতে আস্তানা দুটিতে যায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গিরা দুই স্থানে ৪-৫টি গ্রেনেড চার্জ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। পুলিশের পক্ষ থেকে হ্যান্ড মাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য বারবার আহ্বান করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি। আত্মসমর্পণে পুলিশি আহ্বানের জবাবে অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, বড়হাটের বাসা থেকে নারীকণ্ঠ চিৎকার দিয়ে বলছে ‘আমরা আল্লাহর পথে আছি আল্লাহর কাছে চলে যাবো, আত্মসমর্পণ করবো না।’ নাসিরপুরের ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। পুলিশ সাংবাদিকসহ  নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে কাউকে কাছে যেতে দিচ্ছে না। ঘটনাস্থল থেকে তিনশ’ গজ দূরে অবস্থান নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দায়িত্ব পালন করছেন সাংবাদিকরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিলেট মহানগরের পিবিআইর পুলিশ সুপার রেজাউল করিম মল্লিক সাংবাদিকদের জানান,  পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অভিযান শেষ হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমানের বাড়ি শহরের বড়হাট এলাকায়। গতকাল বিকালে মেয়র জানান, তার বাড়ির পাশে একটি বাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গি আছে সন্দেহে ঘেরাও করে রাখে। এখানে পাল্টাপাল্টি গুলি হচ্ছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন জঙ্গিদের আটক করার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
পুলিশ ও আত্মীয়স্বজন মিলে বৃদ্ধ ইজ্জত উল্লাহকে বের করে আনলেন: সন্দেহ করা জঙ্গি আস্তানা আর পাশের বাড়ি থেকে দুপুর সোয়া একটার সময় বৃদ্ধ ইজ্জত উল্লাহ (৯০)কে একটি চাদরে শুইয়ে দুই পুলিশ সদস্য ও দু’জন আত্মীয় মিলে রাস্তার কাছে এক বাড়িতে নিয়ে আসেন। এই সময় পিছু পিছু দুই মহিলা একটি প্লাস্টিকের চেয়ার ও কিছু ব্যাগ নিয়ে আসতে দেখা যায়। জানা গেছে, ইজ্জত উল্লাহ হচ্ছেন জনৈক শামছুদ্দিনের শ্বশুর। তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা শুধু বলেন, আমরা বিপদে আছি, দয়া করে আপনারা সরে যান।
বাড়ির মালিক প্রবাসী: জঙ্গি আস্তানার বাড়ি দু’টির মালিক সাইফুল ইসলাম লন্ডনপ্রবাসী বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তার বাবা আছদ্দর আলীও লন্ডনপ্রবাসী। গ্রামের বাড়িটির চৌসীমা পাকা দেয়াল আর ঘর পাকা ও টিনশেডের। পুরো বাড়ি প্রায় চার একর জায়গার উপর নির্মিত। পৌর শহরের বড়হাটের বাড়িটি ৩ তলা হলেও ২ তলা রয়েছে ভাড়ায় এবং ৩য় তলা  রয়েছে নির্মানাধীন। খলিলপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের বাড়িটিতে ৩ পরিবারে ১৩ জন সদস্য থাকতেন বলে ওই গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন। সন্দেহভাজন বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল ২ জন পুরুষ, ২ জন মহিলা ও ২টি শিশু। বাড়ি ভাড়া নেয়ার আগে ওই ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছিল তারা একটি  বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তবে গ্রামবাসী অনেকেই জানান ওই ভাড়াটিয়ারা গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশতো কম। তারা কখনো বলতো একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে আবার কখনো বলতো ইলেকট্রেশিয়ানের কাজ করে।
জেলাজুড়ে উদ্বেগ: হঠাৎ দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের খবরে জেলাজুড়ে ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এ উদ্বেগ ছিল প্রবাসেও।  সকাল থেকে দিনভর শহরের অধিকাংশ দোকানপাট রয়েছে বন্ধ। দূরপাল্লার যানবাহন ছাড়া শহরে অপ্রয়োজনীয় যানবাহন চোখে পড়েনি। স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। অনেক অভিভাবক ভয়ে স্কুল থেকে তাদের সন্তানদের বাসায় নিয়ে যান। হঠাৎ শান্ত শহরটির বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক চেপে বসে। শহরের দোকান, অফিস-আদালত ও অলিগলিতেও জনসাধারণের উপস্থিতি ছিল কম। দুপুরে নাসিরপুর মসজিদের সামনেই বসে মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে এমনটিই জানালেন ওই গ্রামের বাসিন্দা ফারুক আহমদ (৫৫), মারাজ মিয়া (৫৮), কালাম মিয়া (৩৫), শাহনুর আলী (৪৩) সহ অনেকেই। খলিলপুর ইউনিয়ন অফিস ও নাসিরপুর মসজিদের সামনে অভিযান দেখতে বসা এই দু’গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষ বলছিলেন দেশের কাছে আমাদের গ্রাম আজ জঙ্গি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অথচ ওই জঙ্গিরা আমাদের এলাকার এমনকি সিলেট বিভাগেরও না। তারা জানালেন ভোর থেকে জঙ্গিদের থেমে  থেমে গুলি নিক্ষেপ ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুরো এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফতেহপুরের অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছেন। আর যারা বাড়িতে আছেন তারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। গ্রামের মানুষরা এত র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে হতবাক।
দুই বাড়িতে নারী: জঙ্গি দুই বাড়িতেই পুরুষের পাশাপাশি নারী জঙ্গি রয়েছে। এমনটি ধারণা করছে পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, দুই আস্তানাতে পুরুষের পাশাপাশি নারী জঙ্গিরাও সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, বড়হাট এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে একজন নারী জঙ্গির গ্রেনেড ছোড়ার পর এমনটিই ধারণা করছে পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *