রুদ্ধশ্বাস ১১০ ঘণ্টা

Slider জাতীয়

59332_thumbS_f2

 

সিলেট; বৃহস্পতিবার রাত দেড়টা থেকে শুরু। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটায় শেষ। রুদ্ধশ্বাস ১১০ ঘণ্টা। শক্তিশালী বিস্ফোরক আর কৌশলে জঙ্গিরা সময় ক্ষেপণ করলেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে জঙ্গিবিরোধী অপারেশন টোয়াইলাইট। প্রায় পাঁচ দিনের এই অভিযান ঘিরে তাকিয়ে ছিল পুরোদেশ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল সর্বত্র। সব উৎকণ্ঠা কাটিয়ে সফল অভিযানের জন্য সেনাবাহিনী ও অভিযান সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছে দেশবাসী। অভিযানের সমাপ্তি টানার সংবাদ সম্মেলনে সেনা সদরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান এই অভিযানকে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাইলফলক বলে উল্লেখ করেন। অভিযান সমাপ্তির মধ্য দিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হয়েছে সিলেটবাসীর। অভিযানের পর গতকাল থেকে শিববাড়ি ও আশপাশের এলাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এদিকে সেনা কমান্ডোদের অভিযান সমাপ্তি ঘোষণার পর আতিয়া মহল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেখানে থাকা বিস্ফোরক উদ্ধার ও অন্যান্য প্রক্রিয়া এখন পুলিশ সম্পন্ন করবে। সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের অধীনের কমান্ডো বাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানে আতিয়া মহলে থাকা ৪ জঙ্গি মারা গেছে। এর আগে সেখানে থাকা ৭৮ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে উদ্ধার করে অভিযানিক দল। সফল এই অভিযানের মধ্যেই আতিয়া মহলের বাইরে বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ গেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জনের। আহত হয়েছিলেন অন্তত ৪৩ জন। রক্তাক্ত এই বোমা হামলায় আহত র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আবুল কালাম আজাদ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।
নিহত চার জঙ্গির পরিচয় না মিললেও তাদের এক জন নব্য জেএমবি’র শীর্ষ নেতা মুসা বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিকে সন্ধ্যায় সিলেটের জালালাবাদ সেনানীবাসে সংবাদ সম্মেলনে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। এ সময় তার পাশে ছিলেন, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া, র‌্যাব-৯ সিইও লে. কর্নেল আলি হায়দার আজাদ আহমদ।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযানে অংশ নেয়ার কথা জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন- দ্বিতীয় দিন ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ দিন কমান্ডোরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৭৮ জিম্মিকে উদ্ধার করেন। এরপর কৌশল অবলম্বন করে নিচে জিম্মি থাকা বাসিন্দাদের উদ্ধার করা হয়। দেশবাসীর দোয়া সঙ্গে নিয়ে সেনা সদস্যরা এই অপারেশন করেছেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন- জঙ্গিদের হাতে কী পরিমাণ বিস্ফোরক ছিল সেটি বলা মুশকিল। তবে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক ছিল সেটি হয়তো আপনারা বাইরে থেকে আন্দাজ করেছেন। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে এখনও বিস্ফোরক থাকতে পারে। মঙ্গলবারও পুরো ভবন থেকে ১০টি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আইইডি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তারা অভিযানের প্রথম দিনই পুরো ভবনের বিভিন্ন স্থানে আইইডি রেখে দিয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন ঠিক কতদিন লাগবে এ ভবনটি বিস্ফোরক মুক্ত করতে তা বলা যাবে না।
লিখিত বক্তব্যে ফখরুল আহসান বলেন, গত ১৫ই মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পুলিশ একটি সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা নিশ্চিত করে সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিববাড়ি পাঠানপাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত একটি বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে। ২৪শে মার্চ রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এলাকাটি ঘিরে ফেলে। রাত আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে তারা নিশ্চিত হন যে, ‘আতিয়া মহল’ এর নিচতলার একটি ফ্লাটে জঙ্গিরা অবস্থান করছে। অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে আতিয়া মহলের নিচ তলার ৬টি ফ্ল্যাট বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। এবং ভবনের মূল প্রবেশ পথের কলাপসিবল গেটটি বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়। একইসঙ্গে ভবনটি সবদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ৫ তলা বাড়িটিতে ৩০টি ফ্ল্যাট আছে। ঘটনার সময় ২৮টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন। জঙ্গিরা পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে।
সিলেট পুলিশ বাহিনী জঙ্গিদের সক্ষমতা ও ২৮টি পরিবারের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তারা তাদের বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন সোয়াটের সহায়তা কামনা করে এবং বাড়িটিকে নিশ্ছিদ্রভাবে ঘিরে রাখে। এ সময় ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে নিজ নিজ ফ্ল্যাটের দরজা-জানালা বন্ধ করে যতটুকু সম্ভব নিরাপদে অবস্থান করার চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে জঙ্গিরা তাদের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসে এবং ভবনের মূল ফটকে বিশালাকৃতির বিস্ফোরক স্থাপন করে। এমনকি একটি ফ্রিজ এবং মোটরসাইকেলেও বিস্ফোরক লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এ ছাড়া পুরো ভবনের সিঁড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক স্থাপন করে পুরো ভবনটিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলে।
ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে সোয়াটের সদস্যরা ২৪ তারিখ আনুমানিক বিকাল ৪টায় সময় অপারেশন এলাকায় উপস্থিত হন। সোয়াটের সদস্যগণ তাদের পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও বিচার বিশ্লেষণ শেষে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা এবং বিস্ফোরক ঝুঁকি বিবেচনা করে সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করেন।
পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সেনাবাহিনী অপারেশনের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ১৭ পদাতিক ডিভিশন ও বিশেষায়িত কমান্ডো দল পরদিন (শনিবার) অভিযান শুরু করে। উপস্থিত পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে সেনাবাহিনী জানতে পারে, ভবনের নিচ তলায় তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা জঙ্গি বিস্ফোরকসহ অবস্থান করছে। একই সময়ে ঢাকা হতে বিশেষায়িত একটি দল হেলিকপ্টার যোগে সিলেট আনা হয়।
তিনি বলেন, অপারেশনে মূলত দুটি বিষয়ে প্রায়োরিটি নির্ধারণ করা হয়। প্রথমত, বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া, দ্বিতীয়ত, জঙ্গিদের নির্মূল করা।
অপারেশনের প্রথম পর্বটি সবেচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কমান্ডোরা তাদের জীবনবাজি রেখে সাহসিকতা ও অভিনব কৌশলে ২৫শে মার্চ দুপুর ১টার মধ্যে ভবন থেকে ৩০ জন পুরুষ-মহিলা, ২১জন শিশুসহ মোট ৭৮ জনকে উদ্ধার করে। দ্বিতীয় পর্বের অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, এই পর্বে সেনা কমান্ডোদের পাশাপাশি স্নাইপার দল এপিসিসহ বিশেষায়িত অনেক সদস্য নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। একটানা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ২৭শে মার্চ বিকালের মধ্যে  চার জঙ্গিকে নির্মূল করা হয়। মূলত গতকাল (২৭শে মার্চ) অভিযান শেষ হয়। তবে বিষদ তল্লাশি ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আজকের দিনটি (মঙ্গলবার) ব্যবহার করা হয়।
জঙ্গিদের লাশ হস্তান্তর সম্পর্কে তিনি বলেন, গতকাল (সোমবার) মৃতদেহ দুটি বের করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি যে দুটি মৃতদেহ ছিল তা সুইসাইডাল ভেস্ট পরিহিত থাকায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। নিরাপত্তা বিবেচনায় পুলিশ প্রশাসনের পরামর্শে ঘটনাস্থলেই এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণের আগে  প্রয়োজনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা হয়। সকল কার্যক্রম শেষে আজ (মঙ্গলবার) বিকালে ভবনটি ক্রাইমসিন হিসেবে পুলিশ প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। সেইসঙ্গে অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’ সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
অপারেশন পরিচালায় সহযোগিতার জন্য পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াট, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অপারেশন টোয়াইলাইট ক্রাইসিস মোকাবিলায় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে। সেইসঙ্গে গণমাধ্যমের সহায়ক ভূমিকার জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *