পরকীয়া প্রেমের কারণে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের ঘটনা বাড়ছে

Slider সারাদেশ

55953_lash

 

ঢাকা; স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। এরকম ঘটনা এখন প্রায়ই শোনা যায়। স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের অধিকাংশ ঘটনার নেপথ্যে পরকীয়া। স্ত্রীদের এভাবে নির্মম হয়ে উঠার পেছনের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সমাজবিজ্ঞনী রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, আমরা উচ্চশিক্ষিত প্রজন্ম গড়ছি। কিন্তু ধর্মীয় ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফেসবুক, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে এখন ছেলেমেয়েরা বিদেশি সংস্কৃতি অনুসরণ করছে। তারা সহজেই পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে। সহজেই হিংস্র হয়ে উঠছে। পারিবারিকভাবে ধর্মীয় এবং নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া জরুরি। কিন্তু অনেক মা-বাবা তাতে গুরুত্ব দেন না।
তিনি বলেন, এদেশের মেয়েরা ছিল নরম মনের, মায়াবী। স্বামী অত্যাচার করলেও বা অন্য কোনো কারণে সংসার ভাঙতে পারে। কিন্তু তারা স্বামীকে খুন করতে পারে- তা কল্পনাও করা যায় না। একটা সময় ছিল মেয়েদের ছেলেবন্ধু হবে তা ভাবা যায়নি। এখন স্যাটেলাইট চ্যানেলের বদৌলতে ইন্ডিয়া ও ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে। দিন-রাত টিভিতে ভিনদেশি সিরিয়াল দেখছে ছেলে-মেয়েরা। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে  বন্ধুত্ব থেকে প্রেম-পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে যাচ্ছে তারা। এজন্য পরিবার থেকেই নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। ভিনদেশি অপসংস্কৃতি এড়িয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন এই সমাজ বিজ্ঞানী। স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের একটি আলোচিত ঘটনা চুয়াডাঙ্গার রাজা হত্যাকাণ্ড। ঘটনাটি ঘটে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি। স্ত্রীর জন্য কেনাকাটা করে বাসায় ফিরেছিলেন রাসেল হক রাজা। ওই দিনটিই ছিল তার জীবনের শেষ দিন। স্ত্রী ও তার প্রেমিকসহ পাঁচ জন মিলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাকে।
ঘটনাটি ঘটে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের সাদেক আলী মল্লিক পাড়ায়। হত্যার পর এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করে স্ত্রী জেসমিন খাতুন। দীর্ঘ ১৭ বছর সংসার করছিলেন এই দম্পতি। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। প্রতিবেশী ও স্বজনরা জানান, কেউ ভাবতে পারেনি স্ত্রীর হাতে জীবন দিতে হবে রাজাকে। চুয়াডাঙ্গা সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমির আব্বাস জানান, বড় বোনের দেবর বাবুর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক ছিল জেসমিনের। জেসমিনের মোবাইলে রেকর্ড করা জেসমিন-বাবুর আপত্তিকর কথোপকথন শোনার পরই স্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ হন রাজা। পরকীয়ার প্রেমের বিষয়টি জেনে যাওয়ায় জেসমিন ও তার প্রেমিক বাবুসহ পাঁচ জন মিলে তাকে হত্যা করে বলে জেসমিন স্বীকার করেছে। হত্যার পর সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে প্রচার করা হয় রাজা আত্মহত্যা করেছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের তদন্তে বিষয়টি প্রকাশ পায়।
একই কারণে প্রিয়তমা স্ত্রীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে মহিদুল ইসলামকে। স্ত্রী পরকীয়া প্রেমে আসক্ত। বিষয়টি জানার পরই কলহ সৃষ্টি হয়। এই প্রেমে স্বামী মহিদুল ইসলামকে বাধা মনে করতো স্ত্রী শাহানাজ পারভীন। শেষ পর্যন্ত প্রেমের বাধা দূর করতেই স্বামীকে হত্যার পরিকল্পন করে। ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ৩রা ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সদরের নিচপুটয়িা গ্রামে। এ বিষয়ে ১৬৪ ধারায় আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে শাহানাজ পারভীন জানায়, একই গ্রামের কাওসার আলীর ছেলে বকুলের সঙ্গে শাহানাজ পারভীনের দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। বিষয়টি তার স্বামী জেনে ফেললে শাহানাজকে বাধা দেয়া হয়। এর জেরে ৩রা ডিসেম্বর রাতে মহিদুলকে খুন করে শাহানাজ।
পরকীয়ায় বাধা দেয়ায় পপ গানের শিল্পী হাসান ইসলাম সুমনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে তার স্ত্রী সায়মা। গত বছরের ১৭ই জুন আদালতে সায়মা তার স্বামীকে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। সায়মা স্বীকার করেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবেশী সালাউদ্দিনের সঙ্গে ছয় মাস আগে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হতো। বিষয়টি জানার পর ফেসবুক ব্যবহারে করতে বাধা দেন সুমন। ১৬ই জুন রাতে সায়মার ফোনে কল দেন তার প্রেমিক সালাউদ্দিন। বিষয়টি জানার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে সুমনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে সায়মা। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। নিহত সুমন ফতুল্লার নন্দলালপুর কবরস্থান রোড এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে আর সায়মা একই এলাকার দেওভোগ আখড়া এলাকার সোবহান আলীর মেয়ে।
পরকীয়ার জের ধরে স্বামীকে হত্যা করে নিজেই ‘নিখোঁজ’ উল্লেখ করে থানায় জিডি করেছিলেন চাঁদপুরের মেয়ে ফাতেমা বেগম হ্যাপি। গত বছরের ১৪ই এপ্রিল শাহরাস্তির নয়নপুর বেপারিবাড়িতে ঘটে এ ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার রাতে জন্ডিসের ওষুধের সঙ্গে স্বামী জামাল হোসেনকে আটটি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেয় হ্যাপি। স্বামী গভীর ঘুমে থাকাবস্থায় বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে বাড়ির পাশে মাটিচাপা দেয়া হয় লাশ। পুলিশের তদন্তে বিষয়টি প্রকাশ পায়। নিহতের ভাই আজাদ হোসেন বলেন, ভাবির পরকীয়ার জেরে বিভিন্ন সময় ভাইয়ের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হতো। পরকীয়ার কারণেই তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তার আগে ৭ই ফেব্রুয়ারি প্রবাসী স্বামীকে হত্যা করে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে স্ত্রী। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের পুটিমারা গ্রামে ঘটে এই ঘটনা। সকালে থানায় ঢুকেই পুলিশকে বলে, ‘আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি। আপনারা আমাকে গ্রেপ্তার করুন।’ মধ্য বয়সী এই নারীর কথা শুনে চমকে উঠেন থানার পুলিশ সদস্যরা। আটক করা হয় ওই নারীকে। তার কথানুসারেই বসত ঘরের বারান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় স্বামী অলিউল্লাহ’র লাশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে চাকরি করছেন অলিউল্লাহ। প্রবাসের আয় দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী মাজেদা বেগমের নামে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন তিনি। গত তিন মাস আগে দেশে ফেরার পর মাজেদার সন্দেহ হয় তার স্বামী সৌদিতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এই সন্দেহ থেকেই কলহের সৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত স্বামীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে স্ত্রী মাজেদা।
পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ নেই। অভিযোগ মদপানের। মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতেন স্বামী ওহিদুল হক স্বপন। দীর্ঘদিন এভাবেই তার সঙ্গে সংসার করছিলেন মৌসুমী ইসলাম নাহার। এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। শেষ পর্যন্ত ইট দিয়ে মাথা থেতলে স্বামী স্বপ্নকে হত্যা করে নাহার। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মালিবাগের আবুজর গিফারী কলেজ সংলগ্ন ১৬৩ নম্বর নিজ বাসায় এ ঘটনা ঘটে। স্বামীকে খুন করে নিজেই তা স্বামীর বোনকে জানান। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরদিন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় মৌসুমী। জবানবন্দিতে মৌসুমী জানায়, মদ পান করে বাসায় ফিরলে স্বপনের সঙ্গে ঝগড়া হয় মৌসুমীর। মৌসুমীর গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করেন স্বপন। সর্বশেষ ভোর রাতে স্বপনকে আবারও গাঁজা সেবন করতে দেখেন স্ত্রী মৌসুমী। আবার শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। স্বপন স্ত্রীর দিকে ইট ছুঁড়ে মারেন। পরে মৌসুমী পাল্টা ইট ছুঁড়লে স্বপনের মাথায় লাগে। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলে ইট দিয়ে মাথা থেতলে স্বামীকে খুন করে মৌসুমী। স্বপন-মৌসুমীর ২৩ বছরের সংসারে কলেজপড়ুয়া একটি ছেলে রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, স্বপনের মাথা, নাক, কপাল থেতলে গেছে। হিংস্রভাবে তাকে একাধিক আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নরসিংদীর মেয়ে মৌসুমী গান করতো বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বাড়ির মালিক স্বপন ছিলেন বেকার।
স্বামীকে খুন করে স্ত্রী হাজির হয়েছে থানায়। স্বীকার করছে হত্যাকাণ্ডের দায়। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল গত ১৯শে জানুয়ারি। ওই দিন সকালে বাড্ডা থানায় ঢুকেই চিৎকার করতে থাকে এক নারী ‘স্যার আমি স্বামীরে খুন করছি, আমারে ফাঁসি দেন।’ শাড়ি পরিহিত মধ্য বয়সী ওই নারীর এক হাতে পলিথিনে মোড়ানো মাংসপিণ্ডজাতীয় কিছু। ওই নারী জানায়, সে তার স্বামী ফজল আলী শেখকে হত্যা করেছে। স্বামীর রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে বাড্ডার আদর্শনগরের বাসায়। হত্যার পর স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে পলিথিনে ভরে সে নিজেই হাজির হয়েছে থানায়। আটক করা হয় ওই নারীকে। ওই নারীর নাম চন্দ্রবাহার।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, স্বামী হত্যার কারণ সম্পর্কে সে জানিয়েছে একে-একে তিনটি বিয়ে করেন তার স্বামী ফজল আলী। চন্দ্রবাহারকে বিয়ের চার-পাঁচ বছর পর রুমি নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। সর্বশেষ কয়েক বছর আগে আগের দুটি বিয়ের কথা গোপন রেখে তৃতীয় বিয়ে করেন ফজল। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বাড্ডার আদর্শ নগর এলাকায় থাকতেন ফজল। পাশেই একটি বস্তিতে সন্তানদের নিয়ে থাকতো চন্দ্রবাহার। ঘটনার দিন দ্বিতীয় স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। খবর পেয়ে ওই বাসায় যায় সে। কিন্তু চন্দ্রবাহারকে দেখে ক্ষিপ্ত হন তার স্বামী। কিন্তু কোনোভাবেই রাতে স্ত্রী চন্দ্রবাহারের সঙ্গে থাকতে চাননি ফজল। তিনি বলেন, ‘যা রাস্তায় বহু লোক আছে। তাদের কাছে গিয়ে থাক।’ এতে ক্ষুব্ধ হয় চন্দ্রবাহার। ফজল ঘুমাচ্ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রবাহারের চোখে ঘুম নেই। রাত জেগে নীরবে কাঁদছিল সে। ভোরে নৃশংস ঘটনাটি ঘটায় এই নারী। পুতা হাতে নিয়ে ঘুমন্ত স্বামীর মাথায় আঘাত করে। রক্তে ভিজে যায় বিছানা। নিস্তেজ হয়ে যান ফজল। একপর্যায়ে স্বামী ফজলের গোপনাঙ্গ কেটে পলিথিন ব্যাগে নিয়ে থানায় চলে যায় চন্দ্রবাহার। ২৫ বছরের সংসারে এই দম্পতির চার সন্তান রয়েছে। ফজল আলী শেখের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বরইমুড়িতে।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থানা এলাকায়। গত বছরের ৬ই অক্টোবর রাতে সীতাকুন্ড থানায় হাজির হয়ে এক নারী বলে, ‘আমি আমার স্বামীকে হত্যা করেছি, আমাকে এরেস্ট করুন।’ ওই নারীর নাম খতিজা বেগম। খতিজার তথ্যের ভিত্তিতে ওই রাতেই জাহাবাদ এলাকার বাসা থেকে তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাদকাসক্ত স্বামী নানাভাবে স্ত্রী খতিজাকে নির্যাতন করতেন। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত স্বামীকে হত্যা করে বলে খতিজা পুলিশকে জানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *