নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায় অস্তিত্ব সংকটে

Slider সিলেট

IMG_20170216_124646

হাফিজুল ইসলাম লস্কর, সিলেট :: অস্তিত্ব সংকটে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায়। সিলেটে ওঁরাও সম্প্রদায়ের অবস্থা আরো করুন। সিলেটের ইতিহাস থেকে মুছে যাবার পথে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায়।

এক সময় এই সম্প্রদায়ের প্রায় এক হাজার পরিবার বসবাস করলেও এখন তা কমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোটায়। অভাব, দারিদ্র্য, সব সময় তাদেরকে মারাত্মকভাবে তাড়িত করলেও তারা একান্তভাবে বসবাস করতে চায় সিলেটে। কিন্তু পারছেন না।

কিছু আগ্রাসী প্রভাব এই সংস্কৃতিমনা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে। এ অবস্থায় ওঁরাও সম্প্রদায়কে ধরে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা।

১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসরত ওঁরাও জাতিসত্ত্বার লোকসংখ্যা ৮৫,০৪১। তাদের অধিকাংশই সিলেট, রাজশাহী এবং ঢাকায় বসবাস করেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হতাশা এবং উদ্বেগের।

রাজশাহী ও ঢাকার পর সিলেটেও তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরও সিলেটে অন্তত হাজার খানেক ওঁরাও পরিবার ছিলো। কিন্তু প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বর্তমানে সিলেটের মাটিতে মাত্র আড়াই শ’ ওঁরাও পরিবার টিকে আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একসময় শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ ছাড়া সিলেট বিভাগের বাকী ৩ জেলাতে ওঁরাও সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ছিলো নগরীর বালুচর এলাকায়।

সেখানে এক সময় কয়েক শ’ ওঁরাও পরিবারের বসবাস ছিল। কিন্তু বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৬৫টি পরিবার। এভাবে প্রত্যেক অঞ্চলেই তাদের সংখ্যা কমছে।

বালুচর ছাড়াও পোড়াবাড়ি এলাকায়ও এক সময় ওঁরাওদের ঘনবসতি ছিলো। এই এলাকায় এখন আছে হাতে গুণা কয়েকটি মাত্র পরিবার।

এছাড়া চিকনাগুল চা বাগানে রয়েছে ১২টি পরিবার, ছড়াগাং চা বাগান এলাকায় ১৫টি পরিবার, গুলনী চা বাগান এলাকায় ৯০টি পরিবার, জাফলংয়ের প্রতাপপুরে ৫টি পরিবার, লালাখালে ৫টি পরিবার এবং খাদিম লালিছড়া এলাকায় প্রায় ৩টি পরিবার রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওঁরাও জনগোষ্টি দিন দিন কমে যাবার অন্যতম কারণ হলো জমি দখল, অবজ্ঞা আর পারিপার্শ্বিকতা।

আবার অনেকে অবহেলা সইতে না পেরে অথবা নিরাপত্তাহীনতার কারণে স্বেচ্ছায় নিজের ভূমি ছেড়ে বিভিন্ন বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
ওঁরাও জনগোষ্ঠীর রয়েছে সহস্র বছরের ইতিহাস। ভারত উপমহাদেশে আর্য সভ্যতা বিকাশের আগেও তাদের অস্তিত্ব ছিল।

তাদের শারীরিক গঠন দেখে নৃতাত্ত্বিকরা তাদেরকে দ্রাবিড়ীয় বলেছেন। ভাষা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে ‘কুরুখ’ ভাষা। দ্রাবিড় ভাষায় ‘কুরুখ’ শব্দের অর্থ মানুষ। কুরুখের পাশাপাশি তারা ‘সাদ্রী’ ভাষায়ও কথা বলে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, কুরুখ ভাষার একটি মিশ্র রূপ এই সাদ্রী ভাষা।

আর্যদের অনার্য দ্রাবিড় বিতাড়ণের কাল থেকে অবিরাম বদলে চলেছে ওঁরাওদের সংস্কৃতি ও ভাষা। খ্রিস্টপূর্বাব্দকালে ওঁরাওরা ভারতের কর্ণাটক থেকে স্থানান্তরিত হতে হতে ভারতের ছোট নাগপুর, রাঁচী, রাজমহল এলাকায় স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলেছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিস্টপূর্বাব্দকালে আর্যদের আক্রমণে পরাজিত হয়ে তারা তাদের ভূখন্ড ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তারপর মোঘল, অবশেষে বৃটিশ শক্তির তাবেদার জমিদার ভূস্বামীদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ওঁরাওরা আবার স্থানান্তরিত হতে হতে এদেরই একটি অংশ বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে।

তারপর তারা এই মাটিকে ভালোবেসে ফেলেন। আপন করে নেন বাংলাদেশের জলহাওয়া ও প্রকৃতিকে। নিয়তিকে গেঁথে ফেলে বাংলাদেশের মানচিত্রের সাথে। বসত গড়া শুরু করে সিলেটের বালুচরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায়।

কিন্তু কিছু ভূমিখেকো তাদের দিকে ফেলে লোলুপ দৃষ্টি। তাদের আগ্রাসী প্রভাব নিরন্ন অথচ সংস্কৃতিমনা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলে। তাদের অনেক জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়া হয়। তারপর তারা অনেকটা ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়ে।

বিশেষ করে ২০০২ সালে ভূমি দখল নিয়ে তাদের উপর খুব নির্যাতন চালানো হয়। এ নিয়ে দেশের গণমাধ্যমও সোচ্চার ছিলো। এতে কিছুটা দমে ভূমিখেকোরা। কিন্তু কিছুদিন পর আবার তাদের উপর চালানো হয় পুরনো খড়গ। বর্তমানে যে কয়টি পরিবার টিকে আছে তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছে। হুমকি ধমকি আর উচ্ছেদের ভয় সারাক্ষণ আছে মাথার উপর। সিলেট ছাড়াও হবিগঞ্জ ও মৌলভী বাজারে ওঁরাওদের কয়েকটি পরিবার রয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে ওঁরাওরা উৎসবমুখর ও বিনয়ী জাতিসত্ত্বা। কৃষি তাদের প্রধান অবলম্বন। কৃষিজীবী ওঁরাওরা ষড়ঋতুর বিচিত্র রূপকে আবাহন করে নৃত্য ও গানে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রাণবাদী ধর্মবিশ্বাসেরও প্রচলন রয়েছে। অন্যান্য মানুষের মতো ওঁরাওরা নানাবিধ বিশ্বাস, সংস্কার ও কুসংস্কারের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। নানা বিপত্তির মধ্যেও তারা ধরে রাখতে চায় তাদের আদি সংস্কৃতি। তাদের গোত্রচেতনা, মানবিক মৌল প্রবণতা, পারষ্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে সুপ্রাচীন কাল থেকে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা এখনও ওঁরাও সমাজে টিকে আছে।

তাদের মধ্যে যত উৎসব, পার্বণ রয়েছে তার সবই কৃষিকেন্দ্রিক। তাদেরও রয়েছে বারো মাসে তেরো উৎসব-পার্বণ। ওঁরাওদের অন্যতম প্রধান উৎসব কারাম। এ ছাড়া বসন্তকালে তারা আয়োজন করে ফাগুয়া উৎসবের। চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে মাটি চৌচির হতে থাকলে ওঁরাওরা ফসলের প্রার্থনায় বেদনার্ত গান গায় নৃত্যের তালে তালে।

ফাগুয়ার পাশাপাশি তাদের রয়েছে নববর্ষের ‘সারহুল’ উৎসব। তাদের আছে ‘সোহরাই’ উৎসব। নিতান্ত অভাবী এই জনগোষ্ঠী সামাজিক কিংবা ধর্মীয় যে কোনো উৎসবে নৃত্য-গীতে তাদের জনজীবনে সুখ আবাহন করে। কারাম উৎসবে, কারাম বৃক্ষের ডাল ঘিরে তারা নেচে নেচে দেবতার কাছে তারা ব্যক্তির সুখ, জনজীবনের সুখ, জাতিসত্ত্বার সুখ প্রার্থনা করেন। তারা মনে করে, ধ্বংসের উন্মত্ততায় মেতে ওঠা মানব জাতিকে রক্ষা করবে কারাম গাছ।

বিশিষ্ট সমাজ গবেষক ড. সাদিকুর রহমান জানান, ভূমিখেকোদের হিংস্ররতা এই ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে বিপন্ন করে তুলেছে। এদের টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নতুবা সিলেটের মাটিকে ভালোবেসে যে কয়টি পরিবার এখনো ঠিকে আছে, এক সময় হয়তো তারাও হারিয়ে যাবে। মুছে যাবে মানচিত্র থেকে ওঁরাওদের নাম।

তিনি আরো জানান, সিলেট ছাড়াও দিনাজপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, নওগা ও খুলনায় ওঁরাওদের বসবাস রয়েছে।

স্থানীয় আদিবাসী ও এনজিও সংস্থার মতে আদিবাসীর সংখ্যা কমার সবচেয়ে বড় কারণ ভূমি দখল। কিছু মানুষের জন্য একটি জাতির ভাগ্যরেখা উলট পালট হয়ে যায়। এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে।

ওঁরাও নেতা মিলন ওঁরাও জানান, সব এলাকাতেই আমাদের সংখ্যা কমছে। ভূমি নিয়ে আমাদের উপর বহু নির্যাতনও হয়েছে অতীতে। একটু শান্তির জন্য অনেক সময় আমরা বাপ দাদার পৈত্তিক সম্পত্তি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আশ্রয় নিয়েছি বিভিন্ন বাগানে।

যারা এখনো বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছেন, তাদেরকে নানা বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও আমরা এদেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে বাচঁতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *