আজ সাগর-রুনি হত্যার ৫ বছর; রহস্য এখনও অন্ধকারে

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

 

53064_f2
ঢাকা; চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছরেও রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে হতাশ-ক্ষুব্ধ পরিবার ও সাংবাদিক সমাজ। তদন্তে বারবার হাত আর বাঁক পরিবর্তন হলেও উল্লেখ করার মতো কোনো তথ্য এখনও জনসমক্ষে আসেনি। উদ্ধার হয়নি হারানো দুটি ল্যাপটপ।
জানা যায়নি প্রকৃত হোতাদের নাম-পরিচয়। আদালতের প্রায় অর্ধশতাধিক ধার্য তারিখেও দেয়া হয়নি মামলার তদন্ত বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন। নিহত সাংবাদিক সাগর সরোয়ারের মা ছালেহা খানম মানবজমিনকে বলেন, সাগর-রুনির পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীর কয়েকদিন আগে গত ৮ই ফেব্রুয়ারি আদালতে তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেয়ার একটা দিন ধার্য ছিল। আমরা আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। কিন্তু তা হলো না। তাতে আবারও আশাহত হয়েছি। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন খুনিকে দেখে যেতে চাইব। জানতে চাইব কেন আমার ছেলে ও ছেলের বউকে খুন করা হয়েছে। তা জানতে না পারলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, রহস্য উদঘাটনের নামে সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো নাটক যেন না হয়। ছয়জন এখনও জেলে। নিরপরাধ কেউ যেন কষ্ট না পায়। ক্ষতির শিকার না হয়। সাগর-রুনির জন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমি মেনে নেবো না।
জানা যায়, রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় দুর্বৃত্তরা সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ওপর হামলা চালায়। তাদের হাতপা বেঁধে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি সকালে ওই বাসা থেকে পুলিশ তাদের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে। তখন সাগর মাছরাঙ্গা ও রুনি এটিএন বাংলায় সাংবাদিকতা করতেন। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডটি সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক মহলেও গুরুত্ব পায় হত্যাকাণ্ডটি। নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। ঘটনাস্থলে ছুটে যান তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তখন পুলিশকে তদন্ত শেষ করতে ৪৮ ঘণ্টার সময় দেন তিনি। এরপর পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও ব্যক্ত করেন নানা আশাবাদ। এরপর একই বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এরপরই তিনি ১০ই অক্টোবরের মধ্যে ওই হত্যারহস্য উদঘাটনে আশা প্রকাশ করেন। আর ৯ই অক্টোবরের মধ্যে জড়িত একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন। পরে ওই ব্যক্তি ধরা পড়লেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুরাহা হয়নি মামলা। ঘটনার প্রথম দিকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। পরে তদন্তের ভার পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর। তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার দু’মাস পর ২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করলে আদালতের নিদের্শে র‌্যাব মামলাটির তদন্তের ভার নেয়। তারপর থেকে র‌্যাব মামলাটি তদন্ত করে আসছে। র?্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত ও ফরেনসিক শাখার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মহিউদ্দীন আহমেদ এখন মামলাটি তদন্ত করছেন। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর র‌্যাব ভিসেরা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে তাদের লাশ তুলে। ভিসেরা পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানা যায়, কোনো ধরনের বিষাক্ত পদার্থে নয় ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ ও আঘাতেই দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা আলামতের মধ্যে ছুরি, ছুরির বাঁট ও বঁটিতে খুনির আঙুলের ছাপ ও ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায় কি না, তা দেখেতে আমেরিকায় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। রাসায়নিক ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আমেরিকার ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল সাগর ও রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত ও পা বাঁধার কাপড়, গ্রিলের অংশ, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া চুল, মোজা, দরজার লক, দরজার চেইন এবং ছিটকিনিও। তাছাড়া মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আটজনসহ সন্দেহভাজন ও নিহত দু’জনের আত্মীয়সহ ২১ জনের মুখের লালা সংগ্রহ করেও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত স্থানীয়, সাগর-রুনির স্বজন এবং সহকর্মীসহ মোট ১৫০ জনের জবানবন্দি নিয়েছে র?্যাব।
আমেরিকা থেকে ওই ফরেনসিক ও রাসায়নিক পরীক্ষার ফলাফলও এসেছে। ২০১৫ সালের ৭ই জুন আদালতে দেয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সেখান থেকে দু’অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএ বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই দু’জনকে আর এখন পর্যন্ত আটক করা যায়নি। যদিও সন্দেহভাজন ১৩০ জনের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এদিকে গত বছরের ২রা অক্টোবর আদালতে জমা দেয়া এক অগ্রগতি প্রতিবেদনে চুরি হওয়া ল্যাপটপ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা জানার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেয়ার বিষয় উল্লেখ করা হয়। সর্বশেষ গত ৮ই ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রতিদেন দেয়ার কথা ছিল। গত বুধবার ঢাকার মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলাম সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতির প্রতিদেন জমা দেয়ার জন্য আগামী ২১শে মার্চ পরবর্তী দিন ধার্য করেন। ওই দিন আদালতে তদন্ত বা অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের এএসপি মহিউদ্দিনকে নির্দেশও দেন তিনি।  তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের এএসপি মহিউদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকের বলেন, অজ্ঞাত ডিএনএ বৃত্তান্ত পাওয়া ওই দু’জনকে খোঁজ করা হচ্ছে। অবশ্য সন্দেহভাজন ১৩০ জনের একটি তালিকাও করা হয়েছে। আর আমেরিকায় পাঠানো আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আসা রিপোর্টগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান মানবজমিনকে বলেন, আদালত থেকে বহুবার সময় নিতে হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। অগ্রগতিও আছে। এত বড় চাঞ্চল্যকর একটি মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে কে না সাফল্যের ভাগিদার হতে চায়। আশা করি পরবর্তীতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবেন।
এদিকে পাঁচ বছরেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ। প্রতি বছরই সাগর-রুনির মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। উচ্চারিত হয় বিচারের দাবি। পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকীতে আজও কর্মসূচির ঢাক দিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি। সকাল ১১টায় ডিআরইউ চত্বরে সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মুরসালিন নোমানী জানান, সাগর-রুনির পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ৫ বছরেও রহস্য উদঘাটন ও খুনিরা গেপ্তার না হওয়ায় শুধু সাংবাদিক সমাজই নয়, দেশবাসীও ক্ষুব্ধ। যতদিন এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিচার না হবে ততদিন সাংবাদিকদের আন্দোলন চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *