প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ ইউনূস সেন্টারের

Slider বাংলার মুখোমুখি

7f6d2555879ce2fd4972c24c030dd7f2-yunus-centreee

ঢাকা; জাতীয় সংসদে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউনূস সেন্টার। প্রতিবাদে বলা হয়েছে, গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে বেশ কিছু ভুল ও অসত্য মন্তব্য করেছেন।
গতকাল শনিবার ইউনূস সেন্টারের ওয়েব সাইটে প্রতিবাদটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কথা অভিযোগের অনেকগুলোই এর আগেও একাধিকবার করা হয়েছে এবং প্রতিবারই ইউনূস সেন্টার এর জবাবও দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকেই এই অভিযোগগুলোর অধিকাংশই বারবার তোলা হচ্ছে এবং প্রতিবারই এসব অভিযোগের পূর্ণ জবাব দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল ওয়েব সাইটে দেওয়া প্রতিবাদে ড. ইউনূস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিটি প্রতিটি বক্তব্যের জবাব তুলে ধরা হয়। ​
ড. ইউনূস কর দেন না, কর এড়ানোর জন্য মামলা করেছেন— প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ড. ইউনূস বরাবরই তাঁর কর পুরোপুরি ও সময়মতো পরিশোধ করে আসছেন। তিনি প্রতি বছর বেশ বড় অঙ্কের টাকা কর দিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে জাতিকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস কখনোই কোনো অজুহাতে তাঁর ওপর ধার্য ন্যায্য কর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। তাঁর কর সংক্রান্ত ফাইলগুলোতে ভুল খুঁজে বের করতে সেগুলো বারবার তদন্ত করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই ফাইলগুলো নিষ্কণ্টক পাওয়া গেছে। পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা দিতে দেশের সকল ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর তথ্য থেকে নতুন কিছু বেরিয়ে আসেনি।

প্রতিবাদে বলা হয়েছে, ইউনূসের আয়ের উৎস ৩ টি। ১) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতার জন্য সম্মানী। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত বক্তাদের একজন। তাঁর আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এটি। ২) পৃথিবীর ২৫ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত তাঁর বইগুলো থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটি। তাঁর বইগুলো নিউইয়র্ক টাইমসের বিচারে পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রীত বইগুলোর তালিকাভুক্ত। ৩) ১ম ও ২য় দ্বিতীয় উৎস থেকে অর্জিত অর্থ মেয়াদি আমানতে জমা রাখার ফলে তার থেকে প্রাপ্ত আয়। ১ম ও ২য় সূত্র থেকে অর্জিত প্রতিটি প্রাপ্তির উৎস তথ্য কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়মিতভাবে জমা দেওয়া হয়ে এসেছে। ফলে তাঁর আয়ের সূত্র সম্পর্কে না জানার কোনোই কারণ নেই। তিনি বক্তৃতা ও বইয়ের রয়্যালটি থেকে প্রাপ্ত আয় আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠিয়ে থাকেন। ড. ইউনূস এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য কর্তৃপক্ষকে দিয়ে থাকেন। ফলে তাঁর আয়ের উৎস সম্পর্কে সরকার কিছুই জানে না-এ কথা একেবারেই সঠিক নয়। এটা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ তথ্য দেয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এ নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশের পরও তারা যদি এ সংক্রান্ত যথাযথ তথ্য প্রদান না করেন, এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন, তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
প্রতিবাদে বলা হয়, এটা সত্য যে, কর অফিস কর্তৃক কিছু কর দাবি সম্পর্কে তিনি আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূসকে আইনের আশ্রয় নিতে হয়েছে কেননা কর আইনের একটি দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত ব্যাখ্যা থেকে কর কর্তৃপক্ষের আকস্মিকভাবে সরে আসার কারণে তাঁর ইতিপূর্বে জমাকৃত সকল ট্যাক্স রিটার্ণের ওপর এর প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে তাঁকে আকস্মিকভাবে একটি বড় অঙ্কের বকেয়া করের মুখোমুখি হতে হয়। প্রফেসর ইউনূস এ বিষয়ে সুবিচারের জন্য আদালতে গিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস একজন ‘প্রতারক’। কেননা তিনি গ্রামীণ ফোন প্রতিষ্ঠার সময়ে তাঁর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্রামীণ ফোনের মুনাফার টাকা গ্রামীণ ব্যাংককে দেননি। গ্রামীণ ফোন কোম্পানিটি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতে, গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ ফোনের একটি যৌথ মূলধনী ব্যবসা হওয়ার কথা ছিল। ড. ইউনূস গ্রামীণ ফোনের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন এবং গ্রামীণ ফোনকে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। তিনি গ্রামীণ ফোনের ৩০ শতাংশ শেয়ার নিজের কাছে রেখে অবশিষ্ট শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
জবাবে ইউনূস সেন্টার বলেছে, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এজেন্সিকে রক্ষিত এ সংক্রান্ত সকল দলিল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি বক্তব্যই ভুল। গ্রামীণ ফোনের জন্ম হয়েছিল একটি দীর্ঘ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ সংক্রান্ত কোনো দলিলই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করবে না।
গ্রামীণ ফোন সংক্রান্ত মৌলিক তথ্যগুলো এখানে উপস্থাপন করা হলো। গ্রামীণ ফোনের জন্ম হয় একটি যৌথ মূলধনী (জয়েন্ট ভেঞ্চার) কোম্পানি হিসেবে। গ্রামীণ ফোনের প্রধান অংশীদার হলেন নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর, যা কিনা নরওয়ে সরকারের মালিকানাধীন। গ্রামীণ ফোনের দ্বিতীয় মালিক হচ্ছে গ্রামীণ টেলিকম যা কোম্পানি আইনের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক কোম্পানি যার কোনো ব্যক্তি মালিক নেই। গ্রামীণ ফোন একটি পাবলিক কোম্পানি। সারা দেশে এর হাজার হাজার ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। গ্রামীণ ফোন একমাত্র টেলিকম কোম্পানি যার ৪৫% শেয়ার বাংলাদেশিদের হাতে। বিশেষ করে ১০ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশের হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হাতে। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু প্রফেসর ইউনূসের কারণে। দেশের অন্য সব টেলিকম কোম্পানির মালিকানা সম্পূর্ণরূপে বিদেশিদের হাতে। গ্রামীণ ফোনে বিনিয়োগের জন্য গ্রামীণ টেলিকম সরোস ফাউন্ডেশনের নিকট থেকে অর্থ ধার করেছিল। গ্রামীণ ফোন প্রতিষ্ঠার সময়ে বা এরপর কখনোই এই কোম্পানিতে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো শেয়ার ছিল না।

গ্রামীণ টেলিকম তার “পল্লী ফোন কর্মসূচি”র মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের গ্রামাঞ্চলে টেলিফোন সেবা বিক্রির সুবিধা দিয়ে থাকে। গ্রামীণ টেলিকমই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম দরিদ্র মানুষের কাছে, বিশেষ করে মহিলাদের কাছে ও গ্রামাঞ্চলে টেলিফোন সেবা পৌঁছে দেওয়ার নজির স্থাপন করেছে। গ্রামীণ টেলিকমের পল্লী ফোন কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামের লাখ লাখ মহিলা উপার্জন ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। এই কর্মসূচির এই বিশেষত্বের কারণে এটি পৃথিবীর যুগান্তকারী একটি প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গ্লাসগো প্রযুক্তি জাদুঘর গ্রামীণ টেলিকমের পল্লী ফোন কর্মসূচি তাদের প্রদর্শনীর অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। প্রযুক্তি জাদুঘরে স্থান পাওয়ায় জাতি হিসেবে আমরা গর্ব করতে পারি। গ্রামীণ ফোনের এই যুগান্তকারী কাজের ফলে বাংলাদেশে টেলিফোন সেবা এখন এত সহজলভ্য। মোবাইল ফোন এখন দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে এমনটি দেশের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষেরও হাতের নাগালে। গ্রামীণ ফোনের লাভের যে অংশ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের কাছে আসে তার পুরোটাই গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানি হিসেবে গ্রামীণ ফোন প্রতিষ্ঠার সময়ে সম্পাদিত চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দলিল এবং গ্রামীণ ফোনের মালিকানা কাঠামো সংক্রান্ত সকল দলিল জনগণের জন্য উন্মুক্ত এবং আগ্রহী যে-কেউ তা দেখতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর ড. ইউনূস ক্ষেপে যান এবং তিনি এবং দেশের একটি প্রখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক পদ্মা সেতুর টাকা আটকে দিতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন এবং হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে লবি করেন। এর জবাবে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত শাসনামলে প্রফেসর ইউনূসের বয়স ৬০ বছর অতিক্রান্ত হয়। কিন্তু সরকার কখনোই তাঁর বয়সের প্রসঙ্গটি তোলেনি। গ্রামীণ ব্যাংকের আইনেও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অবসরের বয়সসীমা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের প্রতিবেদনে অবসরের বয়সসীমা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু ২০১১ সালে প্রসঙ্গটি তোলা হয়। এ পর্যায়ে প্রফেসর ইউনূস হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। হাই কোর্ট শুনানির জন্য তাঁর রিট আবেদন এই মর্মে প্রত্যাখ্যান করেন যে, এই পিটিশন দাখিলযোগ্য নয়, অর্থাৎ আইনের ভাষায় এটা দাখিল করার লোকাস স্ট্যান্ডি তাঁর নেই। এরপর তিনি আপিল বিভাগের কাছে আপিল করেন এবং আপিল বিভাগও একই মর্মে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। প্রফেসর ইউনূস আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে অবিলম্বে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তাঁকে ফোন করে প্রফেসর ইউনূস পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারে প্রভাব খাটিয়েছিলেন-এই অভিযোগ প্রফেসর ইউনূস অতীতেও সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *