‘প্রতিরক্ষা সদস্যদের সম্পৃক্ততা জাতির জন্য কলঙ্কজনক’

Slider বাংলার আদালত সারাদেশ

93261c559db695a60c5dda1495007554-Untitled-9

ঢাকা; নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতাকে ‘জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক’, ‘সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য লজ্জাজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন আদালত। এ ঘটনা ‘আমাদের সকলের মাথা লজ্জায় নুইয়ে দিয়েছে’ উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, নূর হোসেন এর মূল পরিকল্পনাকারী (মাস্টারমাইন্ড)। র‍্যাব সদস্যরা তাঁর সঙ্গে মিলে যৌথভাবে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) এই অপরাধ ঘটিয়েছেন।
আদালত এলিট বাহিনী হিসেবে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কার্যক্রমের প্রশংসার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই বাহিনীতে প্রেষণে নিয়োগ দিতে সতর্কতা অবলম্বনে গুরুত্বারোপ করেছেন। একই সঙ্গে আদালত সাত খুনের ঘটনাকে প্রধানত ‘দুই সন্ত্রাসীর রেষারেষির ফল’ হিসেবে দেখেছেন। আদালত বলছেন, এই হত্যাকাণ্ড মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তাই দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল  বলেন, ‘র‍্যাবের পদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত হওয়া সত্ত্বেও সাত খুনের বিচারে যে হস্তক্ষেপ করা হয়নি, সেটি একটি স্বস্তির বিষয়। এখন কবে এই রায় কার্যকর হবে, তার অপেক্ষা করব।’ তাঁর মতে, র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার যে অভিযোগ রয়েছে, তার কিন্তু বিচার হয়নি। সুতরাং সাত খুনের বিচার হওয়ার কারণে সেসব অভিযোগকে অবজ্ঞা বা লঘু করে দেখা সমীচীন নয়।

নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ১৬ জানুয়ারি সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। এটি সাত খুন হিসেবে পরিচিত হলেও দুটি পৃথক মামলা হিসেবে এর বিচার হয়েছে। সে কারণে দুটি আলাদা রায় হয়েছে। একটি মামলায় নিহত নজরুলসহ পাঁচজন এবং অন্যটিতে আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালককে হত্যা মামলায় রায় ঘোষিত হয়েছে। রায়ে রাষ্ট্রের পাঁচটি বাহিনীর সাবেক ১৬ কর্মকর্তা, সদস্যসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত।

লালসালুতে মোড়ানো ইংরেজিতে লেখা ১৬২ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এসে পৌঁছেছে। সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্টে এখন ডেথ রেফারেন্স নিশ্চিতকরণের জন্য শুনানি হবে। রায় ঘোষণার পরদিনই মেজর (অব.) আরিফসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেকেই জেল আপিল করার জন্য রায়ের অনুলিপি চেয়ে জেল সুপারের মাধ্যমে আবেদন করেছেন। বর্তমানে হাইকোর্টে তিনটি পৃথক বেঞ্চে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিতকরণবিষয়ক মামলার শুনানি চলছে। সাধারণত ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক রায় দানের ক্রমিক অনুসারে তৈরি হয়। তবে কোনো পক্ষ দ্রুত পেপারবুক প্রস্তুত করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা চাইতে পারে।

জ্যেষ্ঠ দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন তাঁর পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবশ্য কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিচারকের ভাষায়, এই হত্যাকাণ্ড দুই সন্ত্রাসীর রেষারেষির ফল। একজন আরেকজনকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে, যার লক্ষ্য হলো সমগ্র এলাকাকে একজনের মুঠোবন্দী করা। রায়ে এটাও ফুটে উঠেছে যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামই শুধু নিশানা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে থাকায় চারজন এবং ‘প্রতিবাদী’ ভূমিকা পালন করায় আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালককে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়েছে। র‍্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়েও নূর হোসেনের সঙ্গে কী করে মেজর আরিফ নিয়মিত ও প্রকাশ্যে তাঁর অফিস ও বাড়িতে যাতায়াত করেছেন, অবৈধ অর্থ হাতিয়েছেন—তা রায়ে বিস্তারিতভাবে চিত্রিত হয়েছে।

আদালতের রায়টি মূলত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দিনির্ভর। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নরসিংদীর র‍্যাব কর্মকর্তা মেজর সুরুজ, যাঁর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে মেজর আরিফ অপহরণের পরে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন, তিনিসহ দুজন বাসযাত্রীর সাক্ষ্য রয়েছে।

আদালত বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এঁদের ২৫ জনই রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং ১০ জন অভিযুক্ত বেসামরিক লোক। তথ্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নথিভুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা সহজেই অনুমেয় যে প্রতিটি গ্রুপ তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে একটি পূর্বপরিকল্পনার আওতায় বেআইনি তৎপরতা চালিয়েছে। নূর হোসেন গ্রুপ যৌথভাবে অন্য গ্রুপের (অভিযুক্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য) সঙ্গে পারস্পরিক সলাপরামর্শ করে নিজেদের সুবিধা চরিতার্থ করতে অপরাধ করেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যরা নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। এ ধরনের তিরস্কারযোগ্য যোগসাজশ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা সর্বদাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত লাভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।

রায়ে বলা হয়, নূর হোসেনের সঙ্গে নিহত নজরুলের বিরোধ ছিল। নূর হোসেন যেহেতু র‌্যাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, সে কারণে নূর হোসেন সেই সুযোগ নিয়ে প্রতিরক্ষা সদস্য ও অন্যদের দিয়ে এ অপরাধ সংঘটনে সফল হয়েছিলেন। নূর হোসেন এই নৃশংস অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী।

আদালত বলেন, নিহত নজরুল এবং অভিযুক্ত নূর হোসেন উভয়ে সমাজবিরোধী এবং সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। এঁদের একজন বর্তমানে আওয়ামী লীগের (এর আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) রাজনীতির অনুসারী হয়েছেন। অন্যজন বিএনপির অনুসারী। সন্ত্রাসীরা কোনো রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী নয়। তারা কেবলÿক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে নূর হোসেন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নজরুল এবং অন্যদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি তাঁরা তাঁদের অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ উধাও করেছেন।

অবশ্য স্থানীয় সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানায়, নূর হোসেন আগে বিএনপিতে ছিলেন, পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আর নজরুল কখনো বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন, পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন।

র‍্যাবের প্রশংসা

 রায়ে আদালত বলেছেন, ‘র‌্যাব একটি প্রশংসাযোগ্য এলিট বাহিনী। প্রেষণে কর্মরত কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ও বিবেকহীন অপরাধীর দ্বারা এই বাহিনী কলঙ্কিত (রেপড) হতে পারে না। জেলা ও দায়রা জজ রায়ে বলেন, ‘আমার কাছে র‌্যাব হলো দায়িত্বশীলতা (রেসপনসিবিলিটি), নৈপুণ্য (এবিলিটি) ও বদান্যতার (বেনিফিশিয়েন্স) প্রতীক। আমাদের সকল জাতীয় সংকটে র‌্যাব তার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। সুতরাং র‌্যাবের অভিযুক্তরা ব্যক্তিগত দায় নিয়ে বেআইনি তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন। একজন ব্যক্তির দায়িত্বহীনতার কারণে পুরো এলিট বাহিনী সমালোচনার শিকার হতে পারে না।’

রায়ে আদালত বলেন, র‌্যাব একটি এলিট ফোর্স হিসেবে কথিত অপরাধ সংঘটন করেনি। এই অপরাধ ব্যক্তির স্বার্থে ও ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যরা ঘটিয়েছেন। কোনো হত্যাকাণ্ডকে আইন সমর্থন করে না। তথ্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নথিভুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রমাণ করে যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তিরা ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যৌথভাবে নিহত ব্যক্তিদের অপহরণ এবং পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেন।

আদালত বলেন, সব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আসামিদের জবানবন্দির পর্যালোচনায় এটাই ফুটে উঠেছে যে অপরাধীরা তাঁদের অপরাধ স্বীকার করেছেন। অপহরণ, ফৌজদারি ষড়যন্ত্র, হত্যা, আলামত নষ্ট করার বিষয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের জবানবন্দিতে দেওয়া ভাষ্য পুরোপুরি সত্য, যা তাঁরা স্বেচ্ছায়, ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়েছেন। প্রসিকিউশন তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছে, তার বিবরণের সঙ্গে আসামিদের দেওয়া বৃত্তান্ত মিলে গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কোনো বাধা নেই। এটা স্পষ্ট যে অভিযুক্ত নূর হোসেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ, এম এম রানা, এমদাদুল হক, মো. আরিফ হোসেন, হীরা, বেলাল, আবু তৈয়ব, শিহাব উদ্দিন, পূর্ণেন্দু বালা, আসাদুজ্জামান নূর, চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু ওরফে মিজান, রহম আলী, আবুল বাসার, আবদুল আলীম, মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন, তাজুল ইসলাম, এনামুল কবির, সেলিম, সানাউল্লাহ ওরফে সানা, শাহজাহান এবং জামাল উদ্দিন হত্যার উদ্দেশ্যে অপরাধ সংঘটন করেছেন।

ষড়যন্ত্র হয়েছিল নূর হোসেনের অফিসে

নূর হোসেনের অফিসে ষড়যন্ত্র হয়েছিল উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নূর হোসেন, দীপু, আলী মোহাম্মদ, চার্চিল, রহম আলী, বাসার, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন হত্যার উদ্দেশ্যে মিলিত হয়েছিলেন। অভিন্ন পরিকল্পনায় গৃহীত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের প্রত্যেকেরই পূর্ণ ধারণা ছিল এবং খুন করার উদ্দেশ্যে নূর হোসেন ছাড়া অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কাঁচপুরে যান। ঘটনায় নূর হোসেনের ব্যক্তিগত উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। তিনি এই অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি অপহরণ থেকে হত্যা পর্যন্ত তদারকি করেছেন। অভিযুক্ত আলী মোহাম্মদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে প্রতীয়মান হয় যে নূর হোসেন নিজে আলী মোহাম্মদ, শাহজাহান, সানাউল্লাহ, বাসার, চার্চিল, রিয়াজ, সেলিম, জামাল, হাসান, রহম আলী, আনোয়ার, জজ মিয়া এবং অন্যদের উপস্থিতিতে অশালীন ভাষায় বলেছেন, নজরুল তাঁকে দারুণভাবে হয়রানি করেছেন। তাই নজরুলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জবানবন্দিতে এই অপরাধে তাঁদের এবং অন্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ স্বীকার করেছেন।

কবে শুনানি

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি শহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চে ২০১১-১২ সালের ছয়টি মামলা (মুফতি হান্নানের মামলা আংশিক শ্রুত) শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত আছে। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে ২০১০-১৩ সালের আটটি ও ২০১৫ সালের দুটি (একটি আংশিক শ্রুত) ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য তালিকায় আছে। এ ছাড়া বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চে সপ্তাহে তিন দিন শুনানি হয়। এই বেঞ্চে ২০০৯ সালের একটি আংশিক শ্রুত এবং ২০১১-১৫ সালের মধ্যকার প্রায় ২১টি ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য কার্যতালিকায় রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান  বলেন, ‘আমার ধারণা, এই মামলার শুনানি ২০২০ সালের আগে শুরু হবে না। তবে রাষ্ট্র উদ্যোগী হলে এর আগে করা অসম্ভব নয়। ক্রমিক এগিয়ে আনার নজির আছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *