সেন্টমার্টিন ভ্রমন যেন জীবনের সৌন্দর্যস্নাত স্বপ্নরাজ্য

জাতীয়

16237935_375045489518556_2125215640_n

 

রায় প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রান্ত, বরিশাল বিভাগীয় ব্যুরোচীফ; পরিদর্শনের পরিতৃপ্তি বাংলাদেশের একমাত্র কোরাল আইল্যান্ডস সেন্ট মার্টিন্‌স দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। এ দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মায়ানমার ( বার্মা) -এর উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত।

এই দ্বীপে প্রচুর পরিমান নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কবে কখন এই প্রবাল দ্বীপটিকে কে বা কারা শনাক্ত করেছিলেন তার সত্যিকারের ইতিহাস সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায় না।লোকের মুখে মুখে জানা যায় বিদেশী বনিক শ্রেণির কিছু মানুষ এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা।এরা বাংলাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ব্যবসা- বানিজ্য বা আর্থ- সামাজিক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে যাতায়াতের পথে এই দ্বীপটিকে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো বলে জানা যায়। ঐ সকল বনিকদের মুখে মুখে ব্যবহৃত হওয়া এই জিঞ্জিরা নামটি কালক্রমে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ ও এর সংলগ্ন এলাকার মানুষের মাধ্যমে জিঞ্জিরা নামেই পরিচিতি পেতে থাকে। এভাবেই এই দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই মানুষ চিনতো। বিশেষ সূত্র মোতাবেক জানা যায় ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাংলাদেশী বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এদের বেশিরভাগই ছিল মৎসজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা এই দ্বীপের উত্তরাংশে বসবাস শুরু করে।এভাবেই একসময় এ দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ দেখা গেছে সেই প্রথম থেকেই।বসতি শুরু হওয়ার পর বাঙালি জেলেরা জলকষ্ট এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ রোপণ করেছিল বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত এভাবেই পুরো দ্বীপটি একসময় ‘নারকেল গাছ প্রধান’ দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরীপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে বলে বিশেষ সূত্র মতে জানতে পাওয়া যায়।সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। এটি উত্তর-দক্ষিণে বেশ খানিকটা লম্বা।এ দ্বীপের তিন দিকে শিলা দ্বারা আচ্ছাদিত যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে।এ শিলা স্তর সহ এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্ট মার্টিনের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তর পাড়া। দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় দক্ষিণ পাড়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সঙ্কীর্ণ লেজের মতো এলাকা। এবং সঙ্কীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের ছোট দ্বীপ আছে যা স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া নামে পরিচিত। এটি একটি জনশূন্য দ্বীপ। ভাটার সময় এই দ্বীপে হেটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময় নৌকা প্রয়োজন হয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। তবে কিছু কিছু বালিয়াড়ি দেখা যায়। এ দ্বীপটির প্রধান গঠন উপাদান হলো চুনাপাথর। দ্বীপটির উত্তর পাড়া এবং দক্ষিণ পাড়া দু’জায়গারই প্রায় মাঝখানে জলাভূমি আছে। এগুলো মিঠা পানি সমৃদ্ধ এবং ফসল উৎপাদনে সহায়ক। দ্বীপটিতে কিছু কৃষি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১শ ৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১শ ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১শ ৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ,২শ ৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১শ ২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত Sea weeds বা অ্যালগি (Algae) এক ধরণের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্ট মার্টিন্সে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে তবে লাল অ্যালগি (Red Algae) বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।[১] অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিল কাঁকড়া,লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল,রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ,উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। [১] সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তা নেই। তবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে কেওড়ার ঝোপ-ঝাড় আছে। দক্ষিণ দিকে কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেয়া, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ ইত্যাদি। সেন্টমার্টিন থেকে দূরের অস্পষ্ট মায়ানমারের পাহাড়শ্রেনী সমূহ প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এখানে লোক বসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে সাত হাজারেরও বেশি লোক বসবাস করে বলে বিশেষ সূত্র মতে ধারনা নেওয়া হয়। বর্তমানে এ দ্বীপের লোকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। পর্যটক ও হোটেল ব্যবসায়ীরাই প্রধানত তাদের কাছ থেকে মাছ কেনেন। ছোট মাছ পাটিতে বিছিয়ে, পিটকালা মাছ বালুতে বিছিয়ে এবং বড় জাতের মাছ পেট বরাবর ফেড়ে মাচায় শুকানো হয়। এ ছাড়াও দ্বীপবাসী অনেকে মাছ, নারিকেল, পেজালা এবং ঝিনুক ব্যবসা করে। এছাড়াও কিছু মানুষ দোকানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ছোট ছোট শিশুরা দ্বীপ থেকে সংগৃহীত শৈবাল পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে থাকে। সম্পূর্ণ সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপেই প্রচুর নারিকেল এবং ডাব বিক্রি হয়। মায়ানমারের আরাকন থেকে বাংলাভাষি রোহিঙ্গাদের দ্বীপঅঞ্চলে প্রায়শই দেখা যায়।বাংলাদেশের মধ্যে এই দ্বীপটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন মৌসুমে এখানে প্রতিদিন ৫টি লঞ্চ বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড হতে আসা যাওয়া করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বর্তমানে বেশ কয়েকটি ভালো আবাসিক হোটেল রয়েছে। একটি সরকারি ডাকবাংলো আছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *