পঞ্চগড়ে শিমুল গাছে পানকৌরির নিরাপদ আবাস

Slider রংপুর

boishakhi_1482643811

পঞ্চগড়: উঁচু পাড়, টলটলে জলের দীঘি দলুয়া। সবমিলিয়ে আয়তন ২০ একরের মতো। নিভৃত কৃষক পল্লির নামের সাথেই জুড়ে গেছে এই দিঘীর নাম। গ্রামের নাম দলুয়া। দিঘীর নাম দলুয়ার দিঘী। ঠিক কবে এই দিঘী খুড়া হয়েছিল স্থানীয়রা কেউ জানেননা। তবে কিছু অংশ অবৈধ দখল করে গড়ে ওঠেছে বসত বাড়ি আর একটি পাড়ে গোরস্থান। অন্য একটি পাড়ে কবে একটি শিমুল গাছ আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল সেই ইতিহাসও কেউ বলতে পারেনা।

অজান্তে সেই শিমুল গাছটি এখন গোটা গ্রামের প্রতিক। কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে দলুয়ায় প্রবেশ করার কয়েক কিলোমিটার আগেই চোখে পড়বে প্রায় অর্ধশত বছরের পুরোনো শিমুল গাছটি। এই শিমুল গাছটি দখল করে নিরাপদে আবাস গড়েছে পানকৌরির দল।

শীতের রোদ মাখা এক ঝলমলে বিকেলে সেই গ্রামে ঢুকার সাথে সাথেই পাখির কিচির মিচির কানে এল। সেই সাথে ঘাড়ে ঝোলানো ক্যামেরা দেখে হই হই রৈ রৈ করে ছুটে এল একদল শিশু। ঘিরে ধরল তারা। অনেকে লুকিয়ে ক্যামেরাও ছুঁয়ে দেখলো। খাতির জমিয়ে কৌশলে তাদের জিজ্ঞেস করলাম কে কে পানকৌরির মাংস খেয়েছো হাত তোল। একটি হাতও উপড়ে ওঠলনা। আবার প্রশ্ন করলাম এখানে এতো পানকৌরি আর তোমরা কেউই পানকৌরির মাংস খাওনি? সবাই বলার চেষ্টা করল এই পাখিদের কেউ মারেনা। আরও নানা বিষয়ে তাদের সাথে কথা বার্তার মধ্যেই জড়ো হয়েছে গ্রামের বেশ কিছু নারী পুরুষ।

পাখিদের নিয়ে কথাবার্তায় বেশ মজা পাচ্ছিল তারাও। পুকুরের পাড়গুলো দখল করে অবৈধ বসত বাড়ি গড়ে ওঠার কাহিনী না বল্লেও তারা জানাল বুঝ হওয়ার পর থেকেই এই শিমুল গাছে পানকৌরিদের আবাস দেখে আসছে। তারা আরও জানায়, দলুয়ার এই শিমুল গাছসহ দিঘীর আশে পাশের বাশ ঝাড়ে শুধু পানকৌরি নয়দেশীয় নানা ধরনের পাখির নিরাপদ আবাস গড়ে ওঠেছে। পাখিদের কলতানে মুখরিত থাকে গোটা গ্রাম। শিশু থেকে বয়স্কদের সবার সাথে কথা বলে যেটা বোঝা গেল পাখিদের সাথে তাদের সখ্যতা গড়ে ওঠেছে এবং সেটা অনেক পুরোনো।

দিঘীর কাছেই বাশ ঝাড় ঘেরা বাড়ি আলেমা বেগমের। বয়স ৩৫ থেকে ৪০ হবে। তিনি বলেন, গ্রামের কেউ পাখি শিকার করেনা। কিন্তু মাঝে মাঝে শহর থিকা লোকজন আসে। বন্দুক নিয়া আসে। তারা বস্তা ভর্তি পাখি নিয়া যায়। মোটরসাইকেল নিয়া আসে। আমরা কিছু কইতে পারিনা। আবার সইতেও পারিনা। কিছু কইলে ভয় দেখায়।

একই কথা জানালো মাদ্রাসা পড়ুয়া ১৪ বছরের ইউনুস আলী সহ আরও অনেকে। ঠিক কোন সময়টাতে পাখিরা থাকে এমন প্রশ্নে শিশুরাই বলা শুরু করে দিল, সকালে ওরা (পাখি) সবাই চলে যায় খাবার খাইতে। বিকেল থেকে আবার ফেরা শুরু করে। এ কথা শুনেই আকাশের দিকে চোখ ফেলতেই দেখা গেল ঝাকঁ বেধে পানকৌরিরা ফিরছে। শিমুল গাছের ডালে ডালে তখন পানকৌরিরা বসে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। সঙ্গীদের সাথে ভালোবাসা বিনিময় করছে। সন্তানদের মুখে তুলে দিচ্ছে আহার।

গ্রামের ২৫ বছরের যুবক কুদরত আলী জানতে চাইলো, যারা পাখি মারতে আসে তাদের শাস্তি দেয়া যায় কি না। তার এমন প্রশ্নের উত্তরে পাখি ও বন্য প্রাণী শিকার বিষয়ক আইন ও মুল্যবোধ নিয়ে ছোট খাটো একটা আলোচনাই হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই তখন বললো এবার কেউ পাখি শিকার করতে এলে প্রতিরোধ করবে।
বোদা উপজেলার কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের দলুয়ার দিঘীর পারে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যা। পাখি আর প্রাণীদের প্রতি নিভৃত এই গ্রামের মানুষের উদাত্ত ভালবাসার কথা শুনে বিদায় নিলাম। পরদিন দুপুরেই আলেমা বেগমের ফোন পাবো এটা ভাবিনি। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার দুইটা লোক বন্দুক দিয়া পাখি মারতাছে। আমরা বাঁধা দিতাছি মানতাছেনা। আপনি এখনি পুলিশ পাঠান। ‘ পুলিশ কে জানানোর আগেই আবার আলেমার ফোন। হাসতে হাসতে সে জানায়, ‘স্যার গ্রামের সকলেই বাইর হয়া আসছে । লোক দুটা মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়া পলায়া গেছে। আমি একটা লোকের শার্টের কলার ছিড়া দিছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *