শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

Slider জাতীয় ঢাকা

 9fbb77aec9325824627ef90503f33b39-pin-73

ঢাকা; রাজধানীর অদূরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ শীতের সকালে নিরিবিলি থাকে। তবে বিজয় দিবসে সূর্যোদয়ের পর থেকেই লাখো মানুষের ঢল নামে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসার ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতিসৌধের বেদি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গতকাল শুক্রবার সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে শহীদদের প্রতি।

গতকাল ছিল বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তি। দিবসটির কর্মসূচি শুরু হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। তাঁরা শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যাওয়ার পর স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সবার জন্য। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব বয়সী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বেদিতে ফুল দিয়েছেন। শহীদদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আবেগ জানিয়েছেন। রাজনীতিক, কূটনীতিক, সমাজকর্মী, সরকারি-বেসরকারি চাকুরে, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধার পুষ্পাঞ্জলিতে ঢেকে যায় বেদি।

সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে জাতির বীর সন্তানদের স্মরণ করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের নেতাদের নিয়ে আবার ফুল দেন শেখ হাসিনা।

জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সাংসদ, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকেরা বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শ্রদ্ধা জানান বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। এ সময় তাঁর সঙ্গে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন।

খালেদা জিয়া স্মৃতিসৌধে পৌঁছানোর আগেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানসহ কয়েকজন নেতা সেখানে অবস্থান নেন। এ সময় মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তিতে প্রত্যয় নেওয়া উচিত যে আমরা একটি নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরি করব। যেখানে প্রত্যেক মানুষ ন্যয়বিচার পাবে এবং প্রত্যেকের কাছে অর্থনৈতিক সুফল পৌঁছে যাবে।’

রাজনৈতিক দলের মধ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি, জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ, অলি আহমদের নেতৃত্বে এলডিপি এবং বাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্পধারা, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, জাকের পার্টি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার সময় অলি আহমদ বলেন, দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতিগ্রস্ত। জনগণকে তাঁরা কিছু দিতে পারছেন না। সাধারণ মানুষকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, এনসিটিবিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফুল দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধে। শ্রদ্ধা জানায় সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

পুষ্পস্তবকের ব্যানারে দেখা যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, দুর্নীতি দমন কমিশন, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, বিভিন্ন গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নাম। এর বাইরে অসংখ্য সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সরকারি দপ্তরের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

সকাল ১০টার দিকে লাল আর সবুজ রঙের পোশাক পরে ফুল হাতে স্মৃতিসৌধে আসেন একদল নারী-তরুণী। সঙ্গে কয়েকজন পুরুষ। বিষয়টি অনেকেরই নজর কাড়ে। শ্রদ্ধা নিবেদন করে বেরিয়ে যাওয়ার পথে জানা গেল, তাঁরা বেদে সম্প্রদায়ের। সাভারের বেদেপল্লিতে তাঁদের বাস। তাঁদের একটি সংগঠন আছে, নাম পোড়াবাড়ি সমাজকল্যাণ সংঘ। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাঁরা।

তাঁদেরই একজন সাজেনূর বেগম বলেন, বেদেদের কল্যাণে পরিচালিত ‘উত্তরণ ফ্যাশন’ নামে তাঁদের যে ছোট পোশাক কারখানা আছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে এই পোশাক। তিনি বলেন, ‘আগামীতেও আমরা আসব, শ্রদ্ধা জানাব।’

সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) কর্মীরা ও হুইলচেয়ারে করে সেখানকার রোগীরা সকালে এসে শ্রদ্ধা জানান। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁদের সহযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানান সকালে।

নেত্রকোনার সিদ্দিক মিয়া আসেন একটি ভ্যানের ওপর লোহা ও টিন দিয়ে তৈরি ১২ ফুট লম্বা একটি নৌকা নিয়ে। নৌকায় বৈঠা হাতে বসে ছিল তাঁর দুই সন্তান সাকিব ও আশিক। তিনি বলেন, গত অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের সময় এটা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে গিয়েছিলেন। পরে ন্যাম ভবনের এক জায়গায় রেখে গিয়েছিলেন। চার দিন আগে ঢাকায় এসে রং করে গত বৃহস্পতিবার রাতে স্মৃতিসৌধ এলাকায় আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভক্ত। তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁকে সালাম জানানোর জন্য এটা করেছি। প্রধানমন্ত্রীর নজরে না আসা পর্যন্ত আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।’

তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণির অনেককে দেখা গেল, স্মৃতিস্তম্ভ পেছনে রেখে একা, যুগল, দলবেঁধে মুঠোফোনে সেলফি তুলছেন।

ভিভিআইপি যাতায়াতের কারণে ফজরের আগ থেকেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যানবাহন ও মানুষের চলাচল বন্ধ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর মহাসড়ক ছেড়ে দেওয়া হয়। স্মৃতিসৌধে প্রতিবছর শ্রদ্ধা জানাতে আসেন এমন কয়েকজন বলেন, এবার মানুষের ঢল একটু বেশি ছিল।

মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে খুব সকালে স্মৃতিসৌধে আসেন কলেজশিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এখানে এলে বিজয়ের গৌরবটা একটু বেশি অনুভব করা যায়। বোধ-চেতনায় দোলা দেয়।’ বিজয়ের দিনে কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশই চাওয়া। আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশের স্বপ্নে প্রতিদিন ঘুম ভাঙে। বিজয়ের দিন স্বপ্নটা আরও রঙিন হয়ে ওঠে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *