নারায়ণগঞ্জে সাত খুন; রায় ১৬ জানুয়ারি,

Slider বাংলার আদালত

16a13f1cda5ec87a1b1e6cfe16fa6cd5-untitled-59

নারায়ণগঞ্জের; সাত খুন মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন, জেরা ও যুক্তিতর্ক শেষ হলো। এখনরায়ের অপেক্ষা। আগামী ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়ার তারিখ ধার্য করেছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন।

গতকাল বুধবার আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায়ের এই তারিখ ধার্য করেন।

নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবং নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, আদালতে যে বিচারিক কার্যক্রম চলেছে, তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট। সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির দাবি করে তাঁরা বলেন, ‘আমরা এখন রায়ের অপেক্ষায় আছি।’
দুই বছর সাত মাস আগের লোমহর্ষ এ ঘটনার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন র্যা বের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৫ সদস্য, যাঁদের একজন হলেন মন্ত্রীর জামাতা। মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ-জগতের নিয়ন্ত্রক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা নূর হোসেন। তাঁর নয়জন সহযোগীও আসামি।
গতকাল সকাল ১০টায় আদালতের কার্যক্রমের শুরুতেই আসামি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম এম রানার আইনজীবী মো. ফরহাদ আব্বাস তাঁর অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর আরও দুই আসামি র্যা বের সাবেক সদস্য বজলুর রহমান ও আসাদুজ্জামান নুরের পক্ষে আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিচারকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) ওয়াজেদ আলী আদালতকে বলেন, ‘আমরা এই ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সম্পৃক্ততা শতভাগ প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। একই সঙ্গে আসামিদের মধ্যে যাঁরা বিত্তশালী রয়েছেন, তাঁদের সম্পদ আইনগত প্রক্রিয়ায় নিয়ে এই ঘটনার যারা ভুক্তভোগী, তাদের দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এরপর প্রধান আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা আদালতকে বলেন, ‘আমাদের আচরণে রাষ্ট্রপক্ষসহ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে আমরা দুঃখিত।’ তিনি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।

দুপুর ১২টা ৪২ মিনিটে বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন বলেন, ‘আজকে মামলা যে পর্যায়ে শেষ হলো, আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া কখনোই তা সম্ভব ছিল না। সবার প্রচেষ্টা ছাড়া এই মামলা এত তাড়াতাড়ি শেষ করা সম্ভব হতো না। এটি অত্যন্ত বড় একটি মামলা।’ তিনি সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
আদালতের কার্যক্রম শেষে সংবাদ ব্রিফিং করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ওয়াজেদ আলী। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর শৃঙ্খলিত বাহিনীর হাতে চারটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। একটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও নারায়ণগঞ্জে সাত খুন। নারায়ণগঞ্জের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে আইনজীবী ও নাগরিক সমাজ বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছে।
ওয়াজেদ আলী বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, হত্যার কাজে যাঁরা সরাসরি সহযোগিতা করেছেন, লাশ গুম করেছেন, তাঁদের নাম আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে চার সঙ্গীসহ গাড়িতে ফিরছিলেন। পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লায় তাঁরা অপহৃত হন। ওই সময় সে পথে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তাঁকে ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিমকেও তুলে নেওয়া হয়। এরপর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নজরুল ও চন্দন সরকারসহ ছয়জনের এবং ১ মে আরেকজনের লাশ পাওয়া যায়। নিহত বাকিরা হলেন নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, তাঁর গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। এ ঘটনায় নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল একই থানায় আরেকটি মামলা করেন।
ঘটনার পরপরই সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা ও নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা ঘটনার জন্য নূর হোসেন ও র্যা ব-১১-এর তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে দায়ী করে আন্দোলনে নামেন। নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র্যা বকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তাঁর এই অভিযোগ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যা ব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ তিন কর্মকর্তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আর নূর হোসেন পালিয়ে যান ভারতে। পরে ভারতের পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

আসামিদের মধ্যে র্যা ব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর (মায়া) জামাতা। আরেক আসামি লে. কমান্ডার এম এম রানা হলেন খুলনা-২ আসনের সাংসদ মিজানুর রহমানের ভাগনির স্বামী।

সাত খুনের মামলায় মোট ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামিদের মধ্যে র্যা বের সাবেক কর্মকর্তা ও সদস্য মিলিয়ে ১৭ জন এবং নূর হোসেনসহ তাঁর ৫ সহযোগী গ্রেপ্তার রয়েছেন। বাকি ১২ জন পলাতক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আটজন র্যা বের সাবেক সদস্য। আসামিদের মধ্যে ২১ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী ছিলেন ১২৭ জন। আদালতে ১০৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চারজন হচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।
যেভাবে ঘটনা ঘটে: নারায়ণগঞ্জের পিপি ওয়াজেদ আলী গতকাল  বলেন, সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দিতে পুরো ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। ঘটনার দিন লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম এম রানা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে দুটি মাইক্রোবাসে তোলেন। এরপর মাইক্রোবাস দুটি নরসিংদীর দিকে রওনা হয়। রানা অপহৃতদেরকে মেজর আরিফ হোসেনসহ র্যা ব-১১-এর ১২ সদস্যের জিম্মায় দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় নেমে যান। আরিফ অপহৃতদের নরসিংদী র্যা বের ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যান। নরসিংদী ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজ মিয়া ক্যাম্প থেকে বের হয়ে এসে আরিফের সঙ্গে কথা বলেন। আরিফ তাঁকে বলেন, তাঁরা একটি অভিযানে এসেছেন, কিছু সময় ক্যাম্পে থাকবেন। কিন্তু সুরুজ মিয়া তাতে রাজি হননি। আরিফ তখন তাঁকে বলেন, তাঁদের কাছে দুপুরের খাওয়ার টাকা নেই। সুরুজ মিয়া তাঁর পকেট থেকে দুই হাজার টাকা দেন। আরিফ ওই টাকা দিয়ে তাঁর সঙ্গীয় সদস্যদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন। এ সময় গাড়িতে অপহৃত সাতজনকে হাত-পা, চোখ ও মুখ বেঁধে রাখা হয়। এরপর তাঁদের নিয়ে শিবপুরের জঙ্গলে চলে যান। সেখানে রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত থাকেন। এ সময় তাঁদের অধিনায়ক তারেক সাঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নারায়ণগঞ্জের পথে রওনা হন। পথে ইনজেকশন দিয়ে অপহৃত সাতজনকে অচেতন করা হয়। আরিফ ফোনে রানাকে দুটি ট্রলার কাঁচপুর ব্রিজের নিচে ল্যান্ডিং স্টেশনে পাঠাতে বলেন। আজমত আলী, রাজ্জাক ও সামাদ নামে তিনজন ট্রলারচালক দুটি ট্রলার সেখানে নিয়ে আসেন।
পিপি ওয়াজেদ আলী বলেন, রাত সাড়ে ১১টা থেকে পৌনে ১২টার দিকে মাইক্রোবাস দুটি ল্যান্ডিং স্টেশনে পৌঁছায়। সেখানে অপহৃত প্রত্যেকের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ ট্রলারে তোলা হয়। লাশগুলোর পেট ফুটো করে প্রত্যেক লাশের সঙ্গে ইটের বস্তা বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ট্রলার দুটি ভোরে নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর ঘাটে পৌঁছালে তারেক সাঈদ সবাইকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর তিনি ও আরিফ র্যা ব সদস্যদের সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করান এবং বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য তাঁদের কিছু হবে না। সব দায়দায়িত্ব তাঁদের (তারেক সাঈদ ও আরিফের)। ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার চেন্নারপুল এলাকায় তারেক সাঈদের মাইক্রোবাস থামান সহকারী পুলিশ সুপার আজিমুল আহসান ও কনস্টেবল আবদুল লতিফ। তারেক সাঈদ পরিচয় দেওয়ার পর আজিমুল তাঁর গাড়ি ছেড়ে দেন।
আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক: মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে আসামির আইনজীবীরা কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন। প্রথমত, যেসব আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁদের আইনজীবী দাবি করেছেন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে এই জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, র্যা ব ক্যাম্পে রক্ষিত আরপি রেজিস্টার, গেমকল ও রাতের রোলকলের যে নথি রয়েছে, তা সংগ্রহ করে মামলায় উপস্থাপন করা হয়নি। তৃতীয়ত, ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ছাড়া কোনো সাক্ষীই ল্যান্ডিং স্টেশনে লাশ নেওয়া এবং লাশ নদীতে ফেলার বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি। চতুর্থত, এ ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ দেওয়া হয়নি।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে নূর হোসেনের আইনজীবী খোকন সাহা বলেন, কাউন্সিলর নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের দীর্ঘদিনের বিরোধের যে কথা বলছে রাষ্ট্রপক্ষ, সেটি প্রমাণ করতে পারেননি। নূর হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, সে মর্মেও কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দেননি।
মেজর আরিফের আইনজীবী এম এ রশিদ ভূঁইয়া বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কাউন্সিলর নজরুলের শ্বশুর দাবি করেছেন, নূর হোসেনের টাকা খেয়ে র্যা ব সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু জেরা চলাকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা এই লেনদেনের পক্ষে প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। তিনি বলেন, ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে লাশ তুলে নিয়ে নদীতে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে কোনো সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
তবে পিপি ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় আসামিদের জড়িত থাকার বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ শতভাগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
হত্যার কারণ: মামলার অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে বলা হয়, নূর হোসেন অবৈধভাবে জমি দখল, শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, কাঁচপুর সেতুর নিচে পাথর-বালুর ব্যবসা, মদের আড়ত, যাত্রার নামে হাউজি, জুয়া খেলা, প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করে প্রতিদিন ৩০-৩৫ লাখ টাকা আয় করতেন। মেজর আরিফ হোসেন আদমজী ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব নেওয়ায় নূর হোসেনের অফিসে প্রতি মাসে ৮-১০ বার যেতেন। ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে নূর হোসেনের কাছ থেকে টাকাও নিয়েছেন আরিফ। এই সুযোগে নূর হোসেন তাঁর প্রতিপক্ষ নজরুল ইসলামকে সরিয়ে দিতে আরিফের সাহায্য নেন। লে. কর্নেল তারেক সাঈদ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অনৈতিকভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার জন্য অন্যের প্ররোচনায় অধীনস্থ কর্মকর্তা ও সদস্যদের দ্বারা অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের নির্দেশ দেন।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আসিফ হোসেন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *