প্রতারণার নতুন ফাঁদে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা

Slider ঢাকা

41489_protarona

 

ঢাকা; ‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি কি রবিন (ছদ্মনাম) স্যারের সঙ্গে কথা বলছি। জি বলছি (অপরপ্রান্তের উত্তর)। স্যার আজ আমাদের কোম্পানি নিয়ে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। দয়া করে বিজ্ঞপ্তিটি দেখবেন স্যার।’ এটা কোনো বৈধ কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের কথোপকথন নয়। এভাবেই এখন প্রতারণার নতুন ফাঁদ তৈরি করেছে প্রতারকরা। এসব ফাঁদে ধরা পড়ছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা। প্রতারকদের কথা অনুযায়ী ধরা পড়লে রক্ষা নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন চারটি দপ্তরের শীর্ষ পদে চাকরি করেছেন এমন চার কর্মকর্তা প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। প্রতারকদের কথামতো বিজ্ঞপ্তি দেখে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। নতুন চাকরিতে যোগদানের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। প্রতারণার শিকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যাওয়ার কয়েক দিন পর অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পাই। ফোনে আমাকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন দেখতে বলা হয়। বিজ্ঞাপন দেখার পর সাগর নামে একজনকে ফোন করি। সাগর আমাকে জানায়, কোম্পানিটি বাংলাদেশ, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত হবে। আমি চাইলে অফিসে গিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে পারি। সাগরের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে  ওই কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। পরদিন কথা অনুযায়ী ওই অফিসের ঠিকানা নিয়ে মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার একটি বাসায় যাই। আমার ফোন পেয়ে বাড়ির নিচতলায় তিন থেকে চার জন অপেক্ষা করতে থাকেন। তাদের বেশভূষা আমাকে বেশ আপ্লুত করে। প্রতারণার শিকার ওই কর্মকর্তা জানান, সিগমা অ্যান্ড সিগমা লিমিটেড নামের কোম্পানির ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যস্ত থাকতে দেখি। দুইটি রুমে বিদেশিরা মিটিং করছিল। সাগর নামের ছেলেটি তখন আমাকে তথাকথিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদে আলমের রুমে নিয়ে যান। মাসুদে আলমের চেহারা দেখতে বেশ মায়াবী। কথোপকথন শুরু করার প্রথমেই আমি কি খাবো তা জানতে চাওয়া হয়। নো থ্যাঙ্কস বলার পর তাদের পীড়াপীড়িতে কিছু খাবারের কথা বলি। এমন সময় অন্য রুমে বসে থাকা বিদেশিরা তথাকথিত এমডির রুমে চলে আসেন। এসেই ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে একজন আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। অন্য আরেক বিদেশি আরবি ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া কোনো ভাষা বুঝি না জানালে তারা আমাকে অনুবাদ করে বিদেশিদের ভাষা বুঝাতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা আমাকে কোম্পানির জন্য দুটি অপশন দেন। প্রথম অপশনে বলেন, আপনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে চাকরি করতে পারেন। বেতন পাবেন মাসিক ৮০ হাজার টাকা। কোম্পানির পক্ষ থেকে আপনাকে একটি গাড়ি দেয়া হবে। তবে গাড়ির জন্য আপাতত টাকা আপনি দেবেন। ১৫ লাখ টাকা দিলেই চলবে। কোম্পানির পক্ষ থেকে বাকি টাকা দেয়া হবে। দ্বিতীয় অপশনে প্রতারক কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলেন, আপনি চাইলে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনাকে কোম্পানির ২০ ভাগ শেয়ার দেয়া হবে। মাসিক সম্মানী পাবেন ৬০ হাজার টাকা। পাশাপাশি কোম্পানির গাড়ি ও লভ্যাংশ সুবিধা পাবেন। দ্বিতীয় অপশনটি বেশি সুবিধাজনক মনে করে আমি এটিই বেছে নেই। ওই মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন বিশ লাখ টাকার চেক দেই। ক্রস চেক দিতে চাইলে তারা জানায়, এলসি করতে হবে আপনি ক্যাশ (নগদ) চেক দিন। তাদের কথা মতো ক্যাশ চেক দেই। চেক দেয়ার পর আমার জন্য একটি রুম দেখিয়ে বলা হয় আপনি এই রুমে বসবেন। ওই দিন অফিসে না বসে বাসায় ফিরে আসি। এরপর টানা দুইদিন অফিস করি। অফিস করার সময়েই তাদের নানা গলদ খেয়াল করি। তৃতীয় দিন অফিসে গিয়ে তালাবদ্ধ দেখতে পাই। সাগর, মাসুদে আলমের ফোন বন্ধ পাই। এরপর বাড়ির গার্ড ও মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। বিষয়টি জানিয়ে আদাবর থানায় জিডি করি। কিন্তু জিডির পর ২০ লাখ টাকা উদ্ধারে আজও পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একই ধাঁচের প্রতারণার শিকার হন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আরেক কর্মকর্তা। ‘ন’ আদ্যাক্ষরের ওই কর্মকর্তাটি প্রতারকদের শিকার হয়ে খুইয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। এখনো পর্যন্ত টাকার খোঁজ পাননি তিনি। আদৌ টাকা পাবেন কিনা এনিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। এ দুই কর্মকর্তার ভাষ্য, অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যাওয়ার সময় মানুষের মন নরম থাকে। অনেকে চাকরি হারিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। ওই সুযোগটি নেয় প্রতারকরা। তাদের রয়েছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। কোন্‌ কর্মকর্তা কবে এলপিআরে যাবেন, কার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য কেমন, কাকে কিভাবে খুশি করা যায়- এ বিষয়গুলো তারা বেশ ভালোভাবে খেয়াল করে। তাই সব কর্মকর্তাকে সাবধানে চলাফেরার পরামর্শ দেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *