নির্বাচনে কে জয়ী হবেন, তার পূর্বাভাস মিলছে বিভিন্ন জরিপ থেকে। এখন প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হতে চলেছে। যেমন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও সমরশক্তির দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় আড়াইশ’ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একজন নারী দেশের সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। শুধু জনমত জরিপ থেকে নয়; সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই বলা যায়, ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি হিলারি ক্লিনটন শপথ নিচ্ছেন। ইতিহাস আরেকটি কারণেও- একই দম্পতি যুক্তরাষ্ট্র ও বোধ করি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পদে নির্বাচনের মাধ্যমে আসীন হচ্ছেন। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, হিলারি ক্লিনটন তো জিতবেনই। প্রশ্ন হচ্ছে, কত বিশাল ব্যবধানে নির্বাচিত হবেন। এটাও বলা হচ্ছে, ১৯৬৪ সালে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ব্যারি গোল্ড ওয়াটার তার অতি উগ্র মতাদর্শের কারণে ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী লিন্ডন বি জনসনের কাছে যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন, ট্রাম্পের ভাগ্যেও হয়তো এ ধরনের পরিণতি ঘটতে চলেছে। ১৯৬৪ সালে ব্যারি গোল্ড ওয়াটার ৪৬টি অঙ্গরাজ্যেই পরাজিত হয়েছিলেন। হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী তার দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজের প্রচারে শামিল করতে পেরেছেন। কিন্তু ট্রাম্পের কাছ থেকে তার দল রিপাবলিকান পার্টির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিজেদের ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন। অর্থাৎ ট্রাম্পের পক্ষে তার নিজের দলও খুব একটা নেই। দলীয় সমর্থন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়া বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- ট্রাম্পের মতো একজন উগ্রবাদী ও অনেকটা মধ্যযুগীয় মতাদর্শের বাহক কীভাবে বা কাদের সমর্থনের ভিত্তিতে একটি প্রধান দলের প্রার্থী হতে পারলেন? তার সমর্থক সংখ্যাও খুব কম নয়। এটাও প্রশ্ন- এরা কারা? পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তার কট্টর সমর্থকরা মূলত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, যাদের অনেকের কোনো কলেজ ডিগ্রিও নেই। অর্থাৎ শিক্ষিত বা জ্ঞানী হিসেবে তাদের গণ্য করা সম্ভব নয়। এ গোষ্ঠীর কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপজ্জনক বার্তা কীভাবে নাড়া দিয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, সে বার্তাটি হচ্ছে- গতানুগতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে নয় এবং এ দেশটি বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছে। এই উগ্রপন্থি গোষ্ঠী ট্রাম্পের পক্ষে অনেকটা যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর এ ধরনের মনোভাব আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ও সমাজ ব্যবস্থায় কী প্রভাব ফেলবে, সেটাই দেখার বিষয়। এ নিয়ে উদ্বেগও শোনা যাচ্ছে। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হচ্ছে যখন ট্রাম্প বলেন, নির্বাচনে পরাজিত হলে ফল মানবেন না। এ ধরনের উক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক সমাজে কিছু না কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিঙ্াত করলে এটা বলা যেতেই পারে, জনগণের রায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তাদের আরেকটি ঐতিহ্য রয়েছে- পরাজিত প্রার্থী প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানান এবং দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে মনে হয়, তিনি দীর্ঘকালের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য লঙ্ঘন করবেন। আইনগতভাবে ও বাস্তবে এতে নির্বাচনের ফলে প্রভাব না পড়লেও সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করার আশঙ্কা যথেষ্ট। একই সঙ্গে তিনি হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে রাখবেন। ট্রাম্পের আসন্ন পরাজয়ের আরেকটি মূল কারণ এই যে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটার ব্লক ও গোষ্ঠী রয়েছে- যেমন কৃষ্ণাঙ্গ, নারী, লাতিন আমেরিকান বা হিস্পানিক এবং মুসলিম। এসব গোষ্ঠীর প্রায় সবাই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এত বড় ভোটার গোষ্ঠীকে খেপিয়ে ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কথা ভাবতে পারেন না।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার গণমাধ্যমকে খেপিয়ে দিয়েছেন। তারা গোষ্ঠীগতভাবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এমনকি রিপাবলিকান দলের গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিতরাও একই অবস্থান নিয়েছে। একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে যেখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জনমত সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রেখে থাকে, সেই তাদেরকে খেপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার নজির আর নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব বিষয় সামনে এনে হিলারি ক্লিনটনকে আক্রমণ ও ক্ষতি করতে পারতেন- যেমন অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টি; তার উগ্রবাদী ও হঠকারী স্টাইলের কারণে সেগুলো নজরেই আনতে পারলেন না। সব ইস্যুতেই তিনি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে। তিনি বড় ব্যবসায়ী। নানা দেশে তার বিনিয়োগ রয়েছে। অন্য দেশে বিনিয়োগ থেকে লাভ বেশি হতে পারে- এটা তিনি জানেন। তিনি কি সেই বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে এনে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ করবেন? রাজনীতিকরা জনপ্রিয়তার জন্য অনেক কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্ন হয়। অর্থনীতিকে এ কারণেই রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে বলা হয়।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, আগামী ৮ নভেম্বর হিলারি রডহাম ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্র্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে চলেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রায় ২শ’ বছর পর। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার ২০ বছরের মধ্যেই সরকারপ্রধান হিসেবে একজন নারীকে নির্বাচিত করতে পেরেছি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, রাজনৈতিক বিশ্লেষক